নিজস্ব প্রতিবেদক: চতুর্থ প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের চলতি দায়িত্ব পালন করা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ সাইদুল আমিনের দুই রকম শিক্ষাসনদ পাওয়া গেছে। একটি শিক্ষাসনদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের, অন্যটি ‘বিতর্কিত’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার। দুটি সনদ নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। খোদ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) তার শিক্ষাসনদে ‘আস্থা’ রাখতে পারছে না। এজন্য সনদ যাচাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি।
গত ১১ জুন আইডিআরএ থেকে মোহাম্মদ সাইদুল আমিনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সু্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়েছে আইডিআরএ। সাইদুল আমিন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক এসইভিপি এবং হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এভিপি ছিলেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ফার স্ট ইসলামী লাইফের সাবেক এসইভিপি মোহাম্মদ সাইদুল আমিনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সঠিকতা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাচাই করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফে সাইদুল আমিনের নিয়োগের সময়ে দাখিলকৃত সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ এবং জীবনবৃত্তান্তের দলিলাদি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
সাইদুল আমিনের দুই রকম তথ্য সম্পৃক্ত শিক্ষাসনদ এসেছে শেয়ার বিজের কাছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়ের অধীনে তৎকালীন সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৯৪-৯৫ সেশনে রসায়ন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনি স্নাতক শেষ করেন। পরীক্ষা দেন ১৯৯৭ সালে। এই সনদটি ইস্যু করা হয় ২০০০ সালের ৪ জানুয়ারি। সনদ অনুযায়ী তার রোল নম্বর ১৫৭৬৫।
সাইদুল আমিন স্নাতকোত্তরও করেছেন স্নাতকের সেশন অর্থাৎ ১৯৯৪-৯৫ সেশনে। জগন্নাথ কলেজ থেকে রসায়ন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন তিনি। তবে তার এই সনদটি কবে ইস্যু করা হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ প্রাপ্ত সনদটিতে বেশ কিছু জায়গায় ঘষামাজা করা হয়েছে। এই সনদে তার রোল নম্বর ৩৭৪৮৬। পরীক্ষা দিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। আর পাসের সন দেখানো হয়েছে ২০০১।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একই সেশনে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করার কোনো সুযোগ নেই। অবধারিতভাবেই দুটি সনদই ভুয়া। সনদ দুটির সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে শেয়ার বিজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, একজন শিক্ষার্থী একই সেশনে অনার্স ও মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারেন না। তাই এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। একটা সময় নীলক্ষেতসেহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অর্থের বিনিময়ে ভুয়া সনদ সহজেই পাওয়া যেত। এটাও সেই প্রক্রিয়ায় হয়তো পেয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাইদুল আমিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তারা (আইডিআরএ) তাদের মতো যেটা যাচাই-বাছাই করে সেটা করবে। আইডিআরএ ফাইল গেলে সেটা যে প্রক্রিয়ায় যাচাই করার, তা তারা করবে। সত্যতা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা থেকে বিবিএ এবং এমবিএ করেছি। তার আগে শুধু এসএসসি ও এইচএসসির সনদ দিয়ে চাকরি করেছি। সিইও পদে নিয়োগ পেতে এই সনদ দিয়েই আইডিআরএতে আবেদন করেছি।’
তবে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফে যোগদানের আগে তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেছেন, সেখানে জমা দেয়া সিভিতে তিনি বিএ পাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা শুরু থেকেই সনদ বাণিজ্যের জন্য বিতর্কিত। সনদ বাণিজ্যের অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ অবৈধ ঘোষণা করে।
গত বছর এক বিজ্ঞপ্তিতে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার বিষয়ে ইউজিসি বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯৫ সালে সরকারের অনুমোদন পায়। কিন্তু আইন না মানায় ২০০৬ সালে সরকার এটি বন্ধ করে দেয়। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, এ বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। ইউজিসির বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১১১ নম্বরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শিক্ষাসনদ নিয়ে জালিয়াতি করার অভিযোগ রয়েছে।
শেয়ার বিজের কাছে আসা সাইদুল আমিনের দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার সনদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) সনদ অনুযায়ী তিনি মার্কেটিং বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৪.০০ স্কেলে পেয়েছেন ৩.৪৮। পাস করেছেন ২০০১ সালে। আর সনদ ইস্যু করা হয়েছে ২০০২ সালের ২৩ জানুয়ারি। সনদে আইডি/রোল উল্লেখ করা হয়েছে ৯৮১৯১৯। তবে প্রাপ্ত সনদে রোল নম্বরটির জায়গা অস্পষ্ট থাকায় এটা স্পষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে ৯৮১৯। সনদটির সিরিয়াল নম্বর ৯৮।
একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইদুল আমিন এমবিএ করেছেন ২০০২ সালে। মার্কেটিং বিভাগে সিজিপিএ ৪.০০ স্কেলে পেয়েছেন ৩.৬৩। তার এই সনদটি ইস্যু করা হয়েছে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। সনদ দুটি ইস্যুর তারিখ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তার (সাইদুল আমিন) ব্যাপারে একটা কমপ্লেইন আছে বোধহয়। তিনি যেহেতু এমডি নন, তাই তার কাগজপত্র আমার কাছে আসেনি। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজপত্র নিয়ে আইডিআরএর সন্দেহ হওয়ার কারণেই কোম্পানিগুলোর কাছে শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে।’