বিশেষ প্রতিনিধি: বিনিয়োগকারীদের দেয়া মার্জিন ঋণ আদায় না হওয়া এখন পুঁজিবাজারের বড় সংকট। বছরের পর বছর ঋণ আদায় না হওয়ায় অনাদায়ী ক্ষতি বা নেগেটিভ ইক্যুইটি বেড়েছে। ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর শেষে প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি বাদে পুঁজিবাজারের সদস্য বিভিন্ন সিকিউরিটিজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মোট নেগেটিভ ইক্যুইটি ৭ হাজার ৮২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের পর সংকট আরও প্রকট হয়েছে। গত ১৫ বছরের পুঞ্জীভূত বোঝা এখন গলার কাঁটায় রূপ নিয়েছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। বিএসইসি থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
তথ্যমতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহায়তায় উদ্ভূত নেগেটিভ ইক্যুইটি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করেতে চায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একইসঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সদস্য সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংককে নিয়ে সভা আহ্বান করার অনুরোধও জানিয়েছে বিএসইসি।
পুঞ্জীভূত অনাদায়ী মার্জিন ঋণ বিষয়ে চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারের সিকিউরিটিজের মূল্য আকস্মিক বড় দরপতন এবং এর ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগকারীদের মার্জিন হিসাবে অনাদায়কৃত ক্ষতি পুঞ্জীভূত হয়, যা বিনিয়োগকারীদের হিসাবে নেগেটিভ ইক্যুইটি আকারে দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যারি ফরওয়ার্ড হয়ে আসছে। এর আগে কমিশন কর্তৃক বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনাসহ এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও নেগেটিভ ইক্যুইটি পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বিগত সময়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজিবাজার থেকে বিদ্যমান নেগেটিভ ইক্যুইটি অবলোপন করার উদ্দেশ্যে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন রাখার নির্দেশনা প্রদান করে, যার সময়সীমা চলতি বছরের গত ৩১ জানুয়ারি পার হয়েছে। একই বিষয়ে হস্তক্ষেপ চেয়ে ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বরের চিঠি দিয়েছিল সংস্থাটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণাত্মক ইক্যুইটির বিপরীতে প্রভিশনিংয়ের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করতে বিএসইসির কাছে অবেদন করা হয়েছে। এছাড়া ঋণাত্মক ইক্যুইটির রিফাইন্যান্সের (পুনঃঅর্থায়ন) জন্য ডিএসই থেকে একটি আবেদন করা হয়েছে, যেটি এরই মধ্যে বিএসইসির পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ডিএসই ও সিএসইর সদস্যভুক্ত সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে এক লাখ ৭৪ হাজার ৪৬৭টি মার্জিন বিও হিসাব থেকে বিনিয়োগকারীদের প্রদান করা মোট মার্জিন ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ১২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ডিএসইর সদস্যভুক্ত সিকিউরিটিজ হাউসগুলো বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দিয়েছে ১১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ ৫ হাজার ১৪৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং সুদ ১ হাজার ১৯১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
ডিএসইর সদস্যভুক্ত সিকিউরিটিজ হাউসগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৩৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো মোট প্রভিশন ১ হাজার ৪৫৮ কোটি ৯ লাখ টাকা রেখেছে।
অন্যদিকে সিএসইর সদস্যভুক্ত সিকিউরিটিজ হাউসগুলো বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ প্রদান দিয়েছে ৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ ৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং সুদ ২১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ফলে সিএসইর সদস্যভুক্ত সিকিউরিটিজ হাউসগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটি দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো মোট প্রভিশন রেখেছে ১ হাজার ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দিয়েছে ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ ২ হাজার ৭০৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা এবং সুদ ১ হাজার ৪৫০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ফলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৫৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মোট প্রভিশন রেখেছে ১ হাজার ২৩৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ডিএসই ও সিএসইর সদস্যভুক্ত সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫২৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মোট প্রভিশন রেখেছে ২ হাজার ৭০১ কোটি ১০ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি বাদে সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮২৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
এর আগে ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ জারি করা বিএসইসির নির্দেশনায় স্টক ডিলার এবং মার্চেন্ট ব্যাংকারদের পোর্টফোলিওর মার্জিন ঋণ হিসাবে আদায় না হওয়া লোকসানের বিপরীতে প্রভিশন রাখার মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, যা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে প্রভিশনিং সংরক্ষণের মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য বিএসইসির কাছে প্রস্তাব দিয়েছে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সহায়তা এবং নেগেটিভ ইক্যুইটির সমাধানের বিষয়টি অর্থ উপদেষ্টার ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদকে অবহিত করেছে ডিএসই ও ডিবিএ।
শেল্টেক ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে সরকারের অনৈতিক চাপ ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো নিয়ম মেনে শেয়ার বিক্রি করে মার্জিনের ঋণ আদায় করতে পারেনি। বরং আইন মানতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে, যে কারণে সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২০১০ সালের ধস-পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়িক মন্দার কারণে আয়-মুনাফা কমায় মার্জিন ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আশা করছি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারি দায়িত্বশীলরা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখবেন।’