মালদ্বীপের নির্বাচন:চীন-ভারতের রাজনৈতিক মহড়া!

মো: নিজাম উদ্দিন

এক.

দক্ষিণ এশিয়ার ছোট এক রাষ্ট্র মালদ্বীপ। মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ বিরাশি হাজার সামথিং। বাংলাদেশের কোনো একটি সংসদীয় আসনেও মালদ্বীপের মোট ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটার আছে।এমন ছোট একটি রাষ্ট্র কেন ভারত চীনের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ালো?
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে জয়ী প্রার্থীকে নূনতম কাস্টিং ভোটের পঞ্চাশ পার্সেন্ট ভোট পেতে হয়।গত নয়ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফা ভোটে কোনো প্রার্থীই কাঙ্ক্ষিত কাস্টিং ভোটের পঞ্চাশ পার্সেন্ট ভোট পাননি।ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বোচ্চ দুইজন প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভোট হয় ৩০ সেপ্টেম্বর।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রান ওফ বা দ্বিতীয় দফার ভোট অনুষ্ঠিত হয় বর্তমান প্রেসিডেন্ট মালডিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ সালেহ এবং প্রোগ্রেসিভ এলায়েন্স জোটের নেতা রাজধানী মালের সিটি মেয়র মোহাম্মদ মুইজ্জুর মধ্যে। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুই প্রার্থীকেও নির্বাচনে ছাপিয়ে যায় দুটো দেশের প্রভাব। ভারত ও চীন।মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে থাকালে মনে হয় নির্বাচন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সালেহ বনাম মোহাম্মদ মুইজ্জুর মধ্যে হচ্ছে না, নির্বাচন যেন ভারত এবং চীনের মধ্যে হচ্ছে।

ভারতপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সালেহর মূল নির্বাচনী স্লোগান হিসাবেই যেন দাঁড়িয়ে ছিল ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পলিসি আর চীনপন্থী মোহাম্মদ মুইজ্জুর ‘ইন্ডিয়া আউট’ পলিসি। ৩০শে সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনপন্থী মোহাম্মদ মুইজ্জুই মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জয়ী প্রার্থী কাস্টিং ভোটের ৫৩.৭৩ এবং পরাজিত প্রার্থী ৪৬.২৭ পারসেন্ট ভোট পায়।

দুই.

এতো ছোট একটা রাষ্ট্র নিয়ে দুটো সুপার পাওয়ারের কেন এতো আগ্রহ? খুব সহজ উত্তর হচ্ছে মালদ্বীপের জিও পলিটিকাল লোকেশন,ভূরাজনৈতিক অবস্থান। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের জাহাজ গুলো ভারত মহাসাগরের যে পথ ধরে বাণিজ্যের উদ্দেশ্য এগিয়ে চলে মালদ্বীপ তার খুব গুরুত্বপূর্ণ পজিশন বিলং করে। ভারত মহাসাগরের এমন এক জায়গায় মালদ্বীপ যেখানটা চীন ভারত উভয়ের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ।দুই পরাশক্তির রাজনৈতিক প্রভাবে মালদ্বীপের রাজনীতিও এখন চীনপন্থী আর ভারতপন্থী ট্যাগে বিভক্ত।

আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব মালদ্বীপে চীনের চাইতেও বেশি। মালদ্বীপের অবকাঠামো, প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষায় ভারতের ভূমিকা স্পষ্ট। ১৯৮৮ সালে তিন দশকের মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচার মামুন আবদুল গাইয়ুমের বিরুদ্ধে যখন দেশে অভ্যুত্থান হয় তখন ভারতপন্থী প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মালদ্বীপে ভারতীয় সেনা পর্যন্ত প্রেরণ এবং গাইয়ুমকে রক্ষা করেন।

২০০৮ সালেই প্রথম বারের মতো মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে তিন দশকের স্বৈরশাসনের পতন পরেও যে আন্নি নাশিদ মালদ্বীপের নতুন গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনিও ছিলেন পুরো দস্তুর ভারত এবং পশ্চিমা ঘেঁষা। আন্নি নাশিদ মালদ্বীপে একটি পুলিশ বিদ্রোহে ক্ষমতা হারান ২০১২ সালে।বছর খানেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন মুহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান। তার সময় থেকেই মূলত মালদ্বীপ সরাসরি চীনা ব্লকে যুক্ত হতে থাকে। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আব্দুল্লা ইয়ামিন ক্ষমতায় আসেন। তিনি ভারত বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানকে মালদ্বীপে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান এবং মালদ্বীপকে চীনের শতাব্দীর মেগা প্রজেক্ট রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে যুক্ত করেন। এরপর থেকে মালদ্বীপে চায়না বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো নির্মাণে
আর্থিক সহায়তা ও ঝণ ব্যাপক হারে বাড়ছে।

চীনপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিন এগারো বছরের সাজা নিয়ে কারাগারে বন্দী। নির্বাচনে জয়ী হলে কারাবন্দী আব্দুল্লা ইয়ামিনকে মুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর। ফলে সাবেক চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট কারাবন্দী আব্দুল্লা ইয়ামিনের মুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।ফলে সাবেক চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিন এবং বর্তমান চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর যৌথ নেতৃত্ব যে মালদ্বীপকে চীনের অনেক বেশি কাছে নিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তিন.

শুধু মালদ্বীপই নয়। এ অঞ্চলের আরও অনেক রাষ্ট্রই এখন এরকম নির্বাচনের ‘মালদ্বীপ সিন্ড্রোমে’ ভুগছে। কোনো রাষ্ট্রের মালদ্বীপের মতো ভূরাজনৈতিক অবস্থান এক দিকে যেমন তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি, অন্য দিকে এটা একটা সুযোগও বটে।সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের নেতৃত্বের কোয়ালিটির উপর। অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে একটা রাষ্ট্রের যেমন শক্তির মূল্যায়ন হয়,রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক অবস্থানও একটা পাওয়ার, একটা ব্লেসিংস।

মালদ্বীপের যে আয়তন, জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক, সামরিক অবস্থান তার কোনোটাই ভারত চীনকে আকৃষ্ট করার মতো না। একমাত্র ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ছোট এই দেশটির নির্বাচনেও দুটো পরাশক্তি প্রভাব বিস্তার করতে চায়। আজ এবং আগামী দিনের যে রাজনীতি তাতে কার অবস্থান কী তার অনেকাংশই নির্ধারিত হবে সমুদ্র কেন্দ্রীক রাজনীতিতে কার অবস্থান কী। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় নব্বই পার্সেন্ট সমুদ্র পথে পরিচালিত হয়।ফলে সমুদ্র, সমুদ্র কেন্দ্রীক দেশ,সমুদ্র বন্দর আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত মহাসাগরে নজরদারির জন্য শুধু চীন ভারত নয় এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের তালিকাতেও মালদ্বীপ।ভূরাজনৈতিক ভাবে যেসব রাষ্ট্র গুলোর অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারাই আগামী দিন গুলোতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠবে। এএক নতুন প্রবণতা যেমনটা-মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হচ্ছে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক