নোমান বিন হারুন: ভারত মহাসাগরের বুকে প্রায় ১ হাজার ২০০টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। এর মধ্যে কমবেশি মাত্র ২০০টিতে জনবসতি রয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। রূপালী বালির সৈকত, মনোমুগ্ধকর সাজানো রিসোর্ট এবং প্রবাল দ্বীপের জন্য বিখ্যাত এ দ্বীপে বছরে বিপুল পর্যটক সমাগম ঘটে। এই পর্যটকদের বড় একটা অংশ ভারতীয়। মালদ্বীপে ভারতীয় দূতাবাসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত থেকে পর্যটক গেছেন ২ লাখ ৪১ হাজার, ২০২৩ সালে ২ লাখ। সাম্প্রতিককালে ভারতীয় ধনী ও উচ্চবিত্তদের ছুটি কাটানোর পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ।
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই মালদ্বীপের দিকে বারবার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ভারত। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে শুরু করে সময়ে সময়ে বিশেষ আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছে ভারত। প্রতি বছর প্রচুর ভারতীয় পর্যটক মালদ্বীপে ঘুরতে যান। দেশ দুটির ব্যবসায়িক সম্পর্কও বেশ দীর্ঘদিনের ও সুদৃঢ়। তবে ‘চীনপন্থি’ প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ সদ্ভাবের পরিবেশ বদলে যেতে থাকে। পর্যটন ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের ছদ্মাবরণে মালদ্বীপে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে ভারত- স্থানীয়দের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাড়তে থাকে ভারতের প্রতি বিদ্বেষ। এমনকি মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে রাস্তায় নামে আমজনতা। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মোড় ঘুরে যেতে থাকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই।
ভারত-মালদ্বীপ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এ চিত্র কয়েক মাস আগেও ছিল ভিন্ন। সেদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ‘ভারতপন্থি’ ইব্রাহিম মুহম্মদ সোলির আমলেও দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। সোলি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে মালদ্বীপের জলসীমায় পরীক্ষামূলকভাবে ভার?তীয় নৌবাহিনীর কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার দিতে সম্মত হন তারা। তাছাড়া মালদ্বীপে মোতায়েন ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘চীনপন্থি’ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। দায়িত্ব নেয়ার পর ভারতের বিরুদ্ধে একের পর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি। এ নিয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। ক্ষমতা নেয়ার পর মইজ্জু প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিয়েছেন। গত মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘নতুন পরিস্থিতিতে চীন-মালদ্বীপের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অতীতের অর্জনগুলোকে নতুন করে গড়ে তোলার ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে।’ চীনা প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘মালদ্বীপের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় সুরক্ষাকবচ হিসেবে সহায়তা দিতে ভূমিকা রাখবে চীন।’ সম্প্রতি তিনি নয়াদিল্লির সঙ্গে চার বছরের পুরোনো নৌচুক্তি বাতিলের কথা ঘোষণা করেন মইজ্জু। ওই চুক্তির বাতিলের ফলে ভারতীয় নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাহায্য করার জন্য মালদ্বীপের নৌসীমায় ‘হাইড্রোগ্রাফিক’ সমীক্ষা চালানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়।
তবে নিকট অতীতে মালদ্বীপের কোনো প্রেসিডেন্টই ভারত ডিঙিয়ে চীন সফরে যাননি। ২০০৮ সালে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মোহাম্মদ নাশিদ প্রথম সফরের গন্তব্য হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। ২০১২ সালে মোহাম্মদ ওয়াহিদ ও ২০১৪ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভারত সফর করেন। পরের দুজন ভারতের প্রতি তুলনামূলক কম সহানুভূতিশীল হওয়ার পরও ভারতকেই তাদের প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু মুইজ্জুর বেইজিং সফর এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তার কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে, মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
জয়ী হলে দেশকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করা হবেÑএমন নির্বাচনী সেøাগান ছিল মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর। তার সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে এত দিনের অপরিহার্য সম্পর্ক কমাতে শুরু করে বিপরীতে ঝুঁকছে চীনের দিকে। বেইজিং সফরে গিয়ে ভারতকে নিজ দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তাকে সেখানে স্বাগত জানান। এই সফরে অন্তত ২০টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ককে উন্নত করতে সচেষ্ট রয়েছে চীন ও মালদ্বীপ।
অবশ্য গ্রেট হল অব দ্য পিপলে জিন পিং তার বক্তব্যে মুইজ্জুকে ‘পুরোনো বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন। মইজ্জুকে লক্ষ্য করে জিন পিং বলেন, সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ পাচ্ছে চীন ও মালদ্বীপ। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে ৮ থেকে ১২ জানুয়ারি চীনে অবস্থান করেন তিনি।
সোলি সরকারের নীতি ছিল ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’। মুইজ্জুর প্রধান নির্বাচনী সেøাগান ছিল ‘আউট ইন্ডিয়া’। দেশকে ভারতের প্রভাবমুক্ত করার ম্যান্ডেট নিয়েই মুইজ্জু ক্ষমতায় আসেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি দেশে অবস্থানরত ৭৫ ভারতীয় সেনাকে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন। ওই সেনারা চুক্তি অনুযায়ী, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা, উদ্ধারকাজ ও পণ্য সরবরাহের জন্য ভারতের দেয়া বিমান ও হেলিকপ্টার পরিষেবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সামুদ্রিক সম্পদের নানা গবেষণার জন্য ইতোপূর্বে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, গত বছরের জুনে নতুন প্রেসিডেন্ট তার মেয়াদ বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দু’দেশের সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের মধ্যেই ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সফরের বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মালদ্বীপের তিন মন্ত্রী- মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ এবং মাহজুম মাজিদ সেখানে মোদিকে ‘পুতুল’ এবং ‘জোকার’ বলে মন্তব্য করেন। ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়। অবশ্য বিতর্কের মুখে পোস্টগুলো মুছে দেয়া হয়। তবে নিজ দেশের বিরোধী দলের চাপের মুখে তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু। মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। মুইজ্জুকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বরখাস্ত করার জন্য পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন সোলিসহ বিরোধী দলগুলো। ভারত-মালদ্বীপ টানাপোড়েনের মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তার দেশে সফররত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুকে আশ্বাস দিয়েছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বতোভাবে সহায়তা করা হবে।
গত মাসের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট করার পর থেকে ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এ ঘটনার জেরে ভারতের একটি বৃহত্তম পর্যটন কোম্পানি মালদ্বীপে তাদের ফ্লাইট বুকিং বাতিল করেছে। এ ঘটনার পর কয়েকজন সেলিব্রিটিসহ অনেক ভারতীয় মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দর্শনীয় স্থানগুলোর তুলনা করে সামাজিক প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করেছেন। মালদ্বীপে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে ভারত ও রাশিয়া থেকে। ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশটি বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত। দেশটির অর্থনীতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল বলে বিশ্বব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। বার্ষিক এই সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। এ বছর প্রায় ২০ লাখ পর্যটক আশা করছে মালদ্বীপ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, চীনের কাছে ১৩৭ কোটি ডলার ঋণ রয়েছে মালদ্বীপের, যা সরকারি ঋণের ২০ শতাংশ। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট থিঙ্ক ট্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের পর থেকে চীনের সংস্থাগুলো মালদ্বীপে আরও ১৩৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতে, ২০২২ সালে মালদ্বীপের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভ্রমণ ও পর্যটন খাত থেকে ৭৯ শতাংশ এসেছে। ২০২৩ সালে ২ লাখ ৯ হাজারেরও বেশি ভারতীয় পর্যটক মালদ্বীপে বেড়াতে গেছে, যা দেশটির পর্যটন আয়ের ১১ শতাংশ নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মালদ্বীপের পর্যটন আয়ে রাশিয়া প্রায় একই পরিমাণ অবদান রেখেছে। চীনও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। মোট ১ লাখ ৮৭ হাজার ১১৮ জন চীনা নাগরিক দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন, যা এই খাতের মোট আয়ের ১০ শতাংশের দাবিদার।
ভারতীয় পর্যটকদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে মালদ্বীপকে বয়কটের ডাক উঠেছে। পর্যটকনির্ভর দেশ মালদ্বীপের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে উঠতে পারে। চীনা বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয়দের বয়কট আন্দোলনের মুখে মালদ্বীপের পর্যটন খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এ বিষয়ে চীনের সিনহুয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক চিয়ান ফং বলেন, চীনা পর্যটকরা মহামারি-পরবর্তী যুগে ধাপে ধাপে মালদ্বীপে যাওয়া বাড়াচ্ছেন। চীনা জনসাধারণের কাছে এটি পর্যটনের অতি প্রত্যাশিত স্থান। তথাকথিত কোনো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কার্যকলাপ বিষয়টিকে প্রভাবিত করবে না।
তবে চীন-মালদ্বীপের সম্পর্ককে কেবল পর্যটন খাত দিয়ে বিবেচনা করাটা হবে অদূরদৃষ্টি ও সংকীর্ণ চিন্তা। জলবায়ু সংকট ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মালদ্বীপের উপকূলীয় সুরক্ষা ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে সহযোগিতা বাড়িয়েছে চীন। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য খাতে চীনের অংশগ্রহণ ও বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
শি জিন পিংয়ের সঙ্গে মুইজ্জুর স্বাক্ষরিত ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা চুক্তি থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। বেইজিংয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকের পর চীন-মালদ্বীপ ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনায় স্বাক্ষর করে। পাশাপাশি বেল্ট অ্যান্ড রোড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি, অবকাঠামো বিনির্মাণ, জনগণের জীবিকা, সবুজ উন্নয়ন এবং ব্লু ইকোনমি ও ডিজিটাল অর্থনীতি বিষয়ে সহযোগিতার নথিপত্রে স্বাক্ষর করে দেশ দুটি।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের একাধিপত্যের মোকাবিলা করতে সক্রিয় মোদি সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়া কোয়াডের মাধ্যমে তারা প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির কারণে দেশটির সঙ্গে ভারতের অতিরিক্ত সখ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আঞ্চলিক জোট-কোয়াডে ভারতে যোগদান করে চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার আশঙ্কাই চীনকে এসব উদ্যোগ নিতে বাধ্য করেছে। এক্ষেত্রে চীনের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন ‘চীন-ঘনিষ্ঠ’ মুইজ্জু। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি মালদ্বীপে মোতায়েন ভারতীয় সেনাসদস্যদের ফেরত পাঠিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি আর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যতম পরাশক্তি চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে মালদ্বীপ দুই দেশের আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। চীনা বিশ্লেষকদের দাবি, প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের আধিপত্যমূলক মনোভাবের কারণে স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় চীনের মতো বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে। জিন পিং বলেন, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় মালদ্বীপকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে চীন।’ তিনি মালদ্বীপের জন্য একটি সম্ভাব্য আশীর্বাদ হিসেবে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মালদ্বীপ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং চীনের সঙ্গে দেশটি এ-বিষয়ক সহায়তা এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। ঠিক নাকের ডগায় চীনের সরব উপস্থিতি ভারতের জন্য যে স্বস্তিদায়ক হবে না, তা সাধারণ দৃষ্টিতেই বোঝা সম্ভব। সব মিলিয়ে ভারত ও চীনের কাছে মালদ্বীপের গুরুত্ব মূলত কৌশলগত কারণে।
সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা ফেলো জাও গ্যানচং বলেছেন, যদিও জনসংখ্যা, আকার-আয়তনের দিক থেকে মালদ্বীপ অনেক ছোট কিন্তু ভূরাজনীতির বিবেচনায় দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারত মহাসাগর আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই চীনের উচিত এই অঞ্চলে বন্ধু তৈরির সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালানো।’
চীনা প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে গ্যানচংয়ের কথাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে। মুইজ্জুর সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি বলেছেন, মালদ্বীপের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার লড়াইকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে চীন। বিপরীতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুও ‘এক চীন’ নীতির প্রতি মালের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ইতোমধ্যে মুইজ্জুর নেতৃত্বে মালদ্বীপের অর্থনৈতিক সূচকগুলো থেকে উদ্বেগজনক চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। মূল্যস্ফীতি ৩.৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। চলতি হিসাবের ঘাটতি দ্বিগুণ হয়েছে। বিদেশি ঋণের বোঝা জিডিপির ১১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। উচ্চতর বাজেট ঘাটতির মধ্যেও মালদ্বীপ সরকার ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।
তবে বিশ্বদরবারে চীনের ভাবমূর্তি কিছুটা ভিন্ন। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে নতুন নতুন দেশকে ঋণের চক্রে আবদ্ধ করার চীনা নীতি কারও অজানা নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, মালদ্বীপের সরকারি দেনার ২০ শতাংশই চীনের কাছে। এর পরিমাণ ১৩৭ কোটি ডলার। শীর্ষ ঋণদাতার তালিকার পরের দুই দেশ ভারত ও সৌদি আরব। ধারণা করা হচ্ছে, ভারত থেকে পর্যটক কমে যাওয়ায় চীনের শরণাপন্ন হয়েছেন মুইজ্জু। প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু চীন সফরে গিয়ে সে দেশের প্রতি আরও বেশি পর্যটক পাঠানোর আরজি জানিয়ে বলেছেন, কভিডের আগপর্যন্ত তার দেশে চীনের পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি আসতেন। তিনি চান, সেই জায়গা চীন ফিরে পাক। আরও বেশি করে পর্যটকেরা মালদ্বীপে আসুন। এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে মুইজ্জু আরেকবার নতুন করে তার চীননির্ভরতার প্রমাণ দিলেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কহানির এটাই প্রধান কারণ। ভারত চায় না, ভারত মহাসাগরে তার ঘরের কাছে এই দ্বীপমালায় চীন ঘাঁটি গাড়ুক।
সব মিলিয়ে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কের এ পালাবদল দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এ অঞ্চলে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিপরীতে হাঁটার যে যাত্রা দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ শুরু করেছে, সে যাত্রায় আরও কয়েকটি দেশ যুক্ত হতে পারে। বৈরী সম্পর্কের কারণে দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে সহায়তার পরিমাণ কমে গেলেও এ ধাক্কা দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পারবে মালদ্বীপ। অন্তত মুইজ্জুর আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি সে ইঙ্গিতই বহন করছে।
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী
আইন ও বিচার বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়