সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: কয়েক বছর ধরেই দেশে বাড়ছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা। অপরদিকে এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী জ্বালানি তেলের দাম। পাশাপাশি দেশীয় বাজারে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। এতে মাসে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা লোকসান গুনছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
লোকসানের ঘাটতি মোকাবিলায় দুই দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিপিসি। তবে সে প্রস্তাব ফেরত দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তাই চলতি অর্থবছর সরকারের কাছে আট হাজার কোটি টাকা তহবিল চেয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারদর পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ২৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দর ছিল ৫৮ ডলার ১৮ সেন্ট। একই সময় ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েলের প্রতি ব্যারেলের দর ছিল ৫২ ডলার ৪৭ সেন্ট। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে গত ৮ নভেম্বরে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দর বেড়ে হয়েছে ৭৩ ডলার ও ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েলের দাম বেড়ে হয়েছে ৬৬ ডলার ২৪ সেন্ট, যা গত তিন বছরের মধ্য সর্বোচ্চ মূল্য। আর সম্প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ানো হয়।
এদিকে দেশের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জন্য দুই দফা প্রস্তাব দেয় বিপিসি। তবে তা অনুমোদন করেনি সরকার। ফলে লোকসান গুনতে শুরু করেছে বিপিসি। এর মধ্যে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলে ১৫ টাকা ৬০ পয়সা ও ডিজেলে ৯ টাকা চার পয়সা লোকসান গুনছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। এতে গড়ে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা করে লোকসান গুনছে বিপিসি। আর মাসে লোকসান ৬০০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (হিসাব) আলতাফ হোসাইন চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, এক বছর ধরে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি দেশে ডলারের দাম ও জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশে সরকার কর্তৃক জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারিত থাকায় গত নভেম্বর থেকে লোকসান করছে বিপিসি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লোকসান করছে ফার্নেস ও ডিজেলে।
বিপিসির হিসাব বিভাগের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বিশ্বের প্রায় সব দেশ তা সমন্বয় করে। আবার জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশগুলো তা কমিয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে দাম হ্রাস-বৃদ্ধি সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব সময় বাড়ানো হয় না। আবার দাম কমলেও তা সমন্বয় করা হয় না। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বিপিসির লোকসানের পাল্লা ভারী হয়। আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে জনগণ তার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পর থেকে বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানির পরিবর্তে বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল কেনা শুরু করেছে। এতে ফার্নেস অয়েলের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপিসির লোকসান বাড়ছে। অথচ দাম যখন কমছিল বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনেকগুলোই নিজ উদ্যোগে ফার্নেস অয়েল আমদানি করত। তখন তাদের মুনাফা বেড়েছে, আবার বঞ্চিত হয়েছে বিপিসি।
সংস্থাটির বিপণন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংস্থাটি অপরিশোধিত (ক্রুড) ও পরিশোধিত (রিফাইন) জ্বালানি তেল এবং লুব অয়েল আমদানি করে ৬৭ লাখ ১৪ হাজার ৮০৪ মেট্রিক টন। এতে আমদানি বাবদ পরিশোধ করতে হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যেক্ষেত্রে আগের অর্থবছরে মোট জ্বালানি আমদানি ছিল ৫৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৯৭ মেট্রিক টন। এতে আমদানি ব্যয় ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জ্বালানি তেল আমদানি বেড়েছে ৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন এবং আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনে চাহিদা এবং ব্যবহার প্রায় ৮০ শতাংশ। আর গ্যাস সংকট ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিনই বাড়ছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা।
এদিকে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিপিসির জ্বালানি পণ্যের মোট বিক্রি ছিল ৬৯ লাখ ৪৮ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৮ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিপিসির জ্বালানি পণ্যের বিক্রি বৃদ্ধি পায় ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৬ মেট্রিক টন, বা প্রায় ১৮ শতাংশ।
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এটিএম সেলিম শেয়ার বিজকে বলেন, গত নভেম্বর থেকে লোকসান শুরু হলেও এখন আমরা সর্বোচ্চ লোকসানের পর্যায়ে আছি। যদিও আমরা গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সব মিলিয়ে মুনাফায় ছিলাম। কিন্তু গত চার মাস তো গড়ে ৬০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছি। এজন্য আমরা সরকারের কাছে আট হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছি।