মাহে রমজানের শিক্ষা কাজে লাগাতে হবে

মাওলানা নাসির উদ্দিন : রমজান মাস পুরোটাই কল্যাণ ও বরকতের মাস। এ মাসে আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দাদের মেঘমালার মতো সুশীতল ছায়া দান করেছিলেন। এ মাসের রোজা দ্বারা তাকওয়ার অনুশীলন দান করেছিলেন। মসজিদের মেহরাবগুলোয় হাফেজ সাহেবদের সুমধুর তিলাওয়াতের ধ্বনিÑযা মূলত মুমিনদের উদ্দেশে রাহমানুর রাহিমের আহ্বান। যে ধ্বনি মস্তিষ্ককে সুশোভিত আর অন্তঃকরণকে করছিল আলোকিত। তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, জিকির ও দোয়া অন্তরকে আল্লাহর নৈকট্যের অনুভূতিতে সিক্ত এবং চোখ থেকে খোদাভীতির অশ্রুবৃষ্টি ঝরিয়েছিল। দেখতে দেখতেই এই ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে যাচ্ছে বা ঘটল। একজন মুমিনের ভেবে দেখা উচিত যে, রমজানে সে কী পেল; এর কী কী প্রভাব ও ক্রিয়া অন্তর এবং মস্তিষ্কে, বোধ ও বিশ্বাসে, কর্ম ও চরিত্রে অবশিষ্ট রইল। রমজানে সে কী পেল এবং রমজানের বিদায়বেলায় সে কী কী খায়ের-বরকত হারাল।

আমরা যদি রোজার পুরো হক আদায় না করে থাকি, তাহলে তাকওয়ার সেই বিশেষ স্তর আমাদের অর্জিত হয়নি; তবুও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। কেননা প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে সামান্য পরিমাণ হলেও তাকওয়ার স্ফুলিঙ্গ অবশ্যই থাকে; আর রোজার মাধ্যমে তাতে কিছু না কিছু বৃদ্ধি অবশ্যই ঘটে থাকে। আর সে সামান্য তাকওয়াকেই যদি সযতেœ লালন করা হয় এবং সে মোতাবেক আমল করা হয়, তাহলে এই সামান্য তাকওয়াই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমার প্রিয় বান্দা, তোমরা যারা নফসের গোলামি করে নিজেদের জীবন গুনাহে পূর্ণ করে ফেলেছ, (তারা) আমার রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু।’ (সুরা জুমা, আয়াত ৫৩)। আল্লাহতায়ালা হাদিসে কুদসিতে নিজেই এরশাদ করেছেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রতি যেরূপ ধারণা রাখে, আমিও তার সঙ্গে সেরূপ আচরণ করি এবং বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমি তার সঙ্গী হই। যদি সে আমাকে একাকী স্মরণ করে, আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়, তাহলে আমি তার দিকে চার হাত অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে, তাহলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।’ (মুসলিম শরিফ ২/৩৪১)

কাজা ও কাফফারার বিবরণ: রমজানের রোজা ভেঙে ফেললে কখনও শুধু কাজা, আবার কখনও কাজা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হয়। কাজা বলা হয় কোনো রোজা ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে ওই রোজা আদায় করে নেওয়াকে। আর রোজার কাফফারা হলো, একটি গোলাম আজাদ করা। আর তা সম্ভব না হলে (যেমন বর্তমানে গোলাম-বাঁদির প্রচলন নেই) ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজা রাখা। মাঝখানে যদি এক দিনও রোজা বাদ দেয় বা ভঙ্গ করে, তাহলে আবার নতুন করে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। উল্লেখ্য, মহিলাদের মাসিক বা ঋতু আসার কারণে যে ক’দিনের রোজা ভাঙ্গবে, এর কারণে তাদের নতুন করে আবার ৬০টি রোজা রাখতে হবে না। আর যদি কেউ ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজা রাখতে অক্ষম হয়, তাহলে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা পেটপুরে খানা খাওয়াবে বা প্রত্যেককে এক ফিতরা পরিমাণ সদকা করে দেবে। (ফাতওয়ায়ে শামি ৩/৩৯০; আল বাহরুর রায়েক ২/৪৮৪; জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৪২৭)

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ দরজায় কড়া নাড়ছে। এক মাসের সিয়াম সাধনার পর সন্নিকটে খুশির ঈদ। পবিত্র রমজানের শুরু থেকেই ঈদুল ফিতরের পবিত্র এ দিনটির জন্য বিশ্বজুড়ে অপেক্ষা করে ধর্মপ্রাণ সব মুসলমান। যে যার সাধ্যমতো এ দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে উদ্যাপন করে থাকেন। ঈদ আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পথের বিড়ম্বনা অগ্রাহ্য করে সবাই ছুটে যান স্বজনের কাছে।

এক মাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা এ দিনটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনসহ খুব আনন্দর সঙ্গে পালন করে থাকে। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। এই পঞ্জিকা অনুসারে কোনো অবস্থায়ই রমজান মাস ৩০ দিনের বেশি দীর্ঘ হবে না। চাঁদ দেখাসাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়ালের প্রারম্ভ গণনা করা হয়। বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারিত হয় দেশের কোথাও না কোথাও চাঁদ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে। মুসলমানরা ঈদের আগে পুরো রমজান মাস রোজা রাখলেও ঈদের দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ বা হারাম।

ঈদের দিন ইসলামিক বিধান অনুসারে দুই রাকাত ঈদের নামাজ ছয় তাকবিরের সঙ্গে ময়দান বা বড় মসজিদে পড়া হয়। ফজরের নামাজের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাজের সময় হয়। এই নামাজ আদায় করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ইমাম কর্তৃক শুক্রবারে জুমার ফরজ নামাজের আগে খুৎবা (ইসলামিক বক্তব্য) প্রদানের বিধান থাকলেও ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে তা নামাজের পরে প্রদান করার নিয়ম। ইসলামের বর্ণনা অণুযায়ী, ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুতবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা মনোযোগ দিয়ে শোনা নামাজির জন্য ওয়াজিব। সাধারণত ঈদের নামাজের পর মুসলমানরা সমবেতভাবে মোনাজাত করে থাকে এবং একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঈদের সম্ভাষণ ‘ঈদ মোবারক’ বিনিময় করে থাকে।

মুসলমানদের বিধান অনুযায়ী ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামি নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে: গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো। এছাড়া সর্বাগ্রে অজু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিধানও রয়েছে।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবগ্রস্ত বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করে, যাকে ‘ফিতরা’ বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায়ের বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। ইসলামে নিয়ম অনুযায়ী, জাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিতরা লাভের যোগ্য।

এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, পুণ্যতায় তা পরিপূর্ণ। এ দিনে অনেক কাজ আছে; যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদ্যাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে অপচয়ে মত্ত হয় এক স্তরের মানুষ এ ঈদকে কেন্দ্র করে। আর পাশের বাড়ির মানুষটি না খেয়ে থাকলেও খবর রাখে না কেউ। তাই বিভেদ ভুলে ঈদ হোক সমতার। ঈদ হোক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের।

ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও এ উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের আরও কাছাকাছি আসে। শুধু মুসলমানই নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। পবিত্র রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতর হচ্ছে সে শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন। এ একটি দিনের জন্য হলেও ধনী-গরিব সবাই দাঁড়াবে এক কাতারে। ভুলে যেতে হবে সব বৈষম্য, সব ভেদাভেদ। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সারা বিশ্বে মুসলমানদের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আমাদের মেলবন্ধনের ভেতর দিয়ে সবাই ভুলে যাক হিংসা-বিদ্বেষ। আমাদের ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য।