Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 6:41 am

মাহে রমজান

ফিতরা বা ফেতরা আরবি শব্দ, যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর (ফিতরের জাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয় যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন। জাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব দুস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে। রোজা পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা সকালের খাদ্য গ্রহণ করা হয়।
সেজন্য রমজান মাস শেষে এ দানকে জাকাতুল ফিতর বা সকালে?র আহারের জাকাত বলা হয়।
নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সব মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রা.) থেকে জানা যায় ফিতরা বলা হয় এমন পরিমাণ অর্থ বা সম্পদকে যা বিশেষ পরিমাণে বিশেষ পদ্ধতিতে জাকাত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে দান করা হয়।
জাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বে সদকায়ে ফিতরা আদায়ের নির্দেশ ছিল। ফিতর পূর্বে যেমন ওয়াজিব ছিল এখনও তেমনি ওয়াজিব রয়ে গেছে।
ফিতরা আদায়ের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তপূর্ণ ঐক্যমত পোষণ করে। ইমাম মালিক (র.) ও শাফেয়ীর (র.) মতে, ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব বা ফরজ নয়, সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আবু হানিফের (রহ.) মতে ওয়াজিব। হাদিসের ভাষায় সদকাতুল ফিতর হলো রোজা খোলার জাকাত। রোজা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। সদকাতুল ফিতর স্বাধীন-মুক্ত পুরুষ-স্ত্রী নির্বিশেষে সব মুসলমানের ওপর ওয়াজিব। এখন বাড়ির কর্তাকে তাদের ফিতরাও আদায় করতে হবে। বিবাহিত মেয়ে লোকের সদকায়ে ফিতর তার স্বামী আদায় করবে। অবিবাহিত হলে নিজের সামর্থ্য থাকলে নিজেই আদায় করবে। নইলে তার অভিভাবক আদায় করতে হবে। ফকিদের মতে, যার পক্ষে জাকাত গ্রহণ জায়েজ তার পক্ষে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে এক হাদিসে আছে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে গরিব ফকিরদেরও ফিতরা আদায় করা দরকার। কারণ, সে যা দেবে আল্লাহ তার পরিমাণের চেয়ে বেশি ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক নয় স্বেচ্ছামূলক। অধিক সওয়াব পাওয়ার আশায় বান্দার আত্মোৎসর্গের ব্যাপার। সদকায়ে ফিতর গরিব, মিসকিন ও অসহায় মানুষের প্রাপ্য।
হাদিসে সদকায়ে ফিতরার পরিমাপ ধরা হয়েছে এক ‘ছা’। ‘ছা’ আবার দুই ধরনের একটি হিজাজি অন্যটি ইরাকি। হিজাজি এক ‘ছা’র পরিমাণ আমাদের দেশের পৌনে তিন সের আর ইরাকি ‘ছা’র পরিমাণ চার সের। আমাদের ফকিরা এবার ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ ধরেছেন ৬০ টাকা। কিন্তু হাদিসের পরিমাণে এর অনেক বেশি হওয়ার কথা। তাই আমরা ৬০ টাকার বেশি দেওয়ার চেষ্টা করব।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) জাকাতুল ফিতরাকে ফরজ করেছেন, রোজাদারকে বেহুদা নির্লজ্জ কথাবার্তা ও অবাঞ্ছনীয় কাজকর্মের মলিনতা হতে মুক্ত করার এবং (ঈদের দিনে) গরিব মিসকিনরা যাতে একটু ভালো খেতে পারে সে উদ্দেশ্যে। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে জাকাতুল ফিতরা আদায় করবে আল্লাহর নিকট তা ওয়াজিব জাকাত বা সদকা আদায় হিসেবে গৃহীত হবে। আর যে ঈদের নামাজের পর আদায় করবে তা সাধারণ দান রূপে গণ্য হবে। আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।
উপরোক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায়, সদকায়ে ফিতর আদায়ের সঠিক সময় হলো ঈদের নামাজের পূর্বেই। ঈদের নামাজের পূর্বে বলতে বুঝায় দু’একদিন আগে থেকে শুরু করে ঈদের নামাজের দিন নামাজের পূর্ব পর্যন্ত। এর তাৎপর্য এ যে, অভাবী মানুষদের যাতে অভাবের তাড়নায় ঈদের দিনে ঈদের আনন্দ ও খুশি থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। ঈদের বেশি আগে সদকাতুল ফিতর দিয়ে দিলে নানা প্রয়োজনে তারা টাকা খরচ করে ফেলবে। ঈদের দিনে একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সাহাবায়ে কিরামগণ (রা.) সদকায়ে ফিতর ঈদের দু’একদিন আগেই আদায় করতেন। যাতে প্রাপকগণ ঈদের দিনের জন্য কেনাকাটা বা ঈদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে।
জাকাত, ওশর, দান, সদকা, ফিতরা সবই ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর মধ্যে শামিল। এ সবগুলোই মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা যথাযথভাবে যদি এগুলোর চর্চা করি সমাজের সবাই বিশাল ধনী হয়ে যাবে এটা উদ্দেশ্য নয়। খোলাফায়ে রাশেদীনদের (রা.) আমলে মুসলিম সমাজের আর্থিকতা এতটাই উন্নত হয়েছিল যে, জাকাতদাতা জাকাতগ্রহীতা খুঁজে পেতেন না। এর মূল কারণ হলো যে, সে সমাজের সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী জাকাত ওশর দান, সদকা ও ফিতরা আদায়ে যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। আমাদের দেশের জাকাত, ফিতরা যথারীতি আদায় হলে আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমাদের দেশের মানুষকেও কোনো অভাব স্পর্শ করতে পারবে না।