শেয়ার বিজ ডেস্ক: অং সান সু চি এবং তার সরকারের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরেই উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার দেশটির সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। পার্লামেন্টে প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার দিনেই সু চি, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ও অন্য জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের আটক করেছে সেনাবাহিনী। তারা দেশটির ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। এদিকে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন দেশটির গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী সু চি। খবর: বিবিসি ও রয়টার্স।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে একটি বিবৃতি দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। তাদের মালিকানাধীন মিয়াওয়াদ্দি টেলিভিশনে
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তা পড়ে শোনানো হয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়, নির্বাচনে জালিয়াতির পর বেসামরিক সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সার্বভৌমত্ব ও বিভাজন রুখতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এক বছর জরুরি অবস্থা কার্যকর থাকবে বলেও জানানো হয়।
সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) জ্যেষ্ঠ নেতাদের দেশটির সেনাবাহিনী আটক করার কয়েক ঘণ্টার মাথায় জনবিক্ষোভের ডাক দেন এনএলডির এ নেত্রী। তার নামে প্রচারিত এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের জনগণকে বিক্ষোভ দেখানোর আহ্বান জানানো হয়। সু চি বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটিতে আবার জান্তা শাসন কায়েম করার চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি মেনে না নেয়ার জন্য আমি জনগণের কাছে অনুরোধ জানাই।’ মিয়ানমারের জনগণকে উদ্দেশ করে সু চি বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ঐকান্তিকভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানাই।’ সু চির বিক্ষোভের ডাকে দেশটির অনেক মানুষ সাড়া দেবেন বলে মনে করেন মিয়ানমার-বিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিসন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের জনগণ ফের পুরোপুরি জান্তা শাসনে ফিরতে চাইবে না।
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। এই জয় মেনে নেয়নি সেনাবাহিনী। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছে সেনাবাহিনী। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করবে, এমন গুঞ্জন চলছিল।
সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং কিছুদিন আগে এক বক্তব্যে মিয়ানমারের সংবিধান বাতিল করার হুশিয়ারি দেন। এরপরই উত্তেজনা চরমে ওঠে। গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তা, রাজধানী নেপিডো ও অন্যান্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই সত্যি হয়েছে। স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ত ও অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করে সেনাবাহিনী। এর কিছু পরই এক বছরের জন্য দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হ্লাইংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলো। এ ছাড়া দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল মিন্ত সুয়ে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার পর থেকেই বেশিরভাগ সময় সেনাশাসন চলেছে মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেন জেনারেল নি উইন। সরকার পরিচালনার জন্য বেসামরিক প্রশাসন যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। পরের ২৬ বছর সরকার পরিচালনা করেন নি উইন। ১৯৮৮ সালে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। এর কয়েক সপ্তাহ পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের কথা বলে সামরিক নেতাদের নতুন একটি দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
২০১১ সালে জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধানে দেশটির সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর হাতে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের পার্লামেন্টে নির্ধারিত আসনের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী। তাই যেকোনো পরিবর্তনের জন্য সামরিক আইনপ্রণেতাদের সমর্থন প্রয়োজন।
ইয়াঙ্গুনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক খিন জ উইন বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির সংবিধানকে ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় করে তুলেছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই সু চি ও তার সরকার সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে খুব সামান্যই সফলতা এসেছে।
শেষ মেয়াদে সু চি নেতৃত্বে বাধা আসে, এমন একটি নিয়ম নিষ্ক্রিয় করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সো মিন্ত অং বলেন, আইনের এমন ফাঁকফোকরের কথা সেনাবাহিনী আগে ভাবেনি। সেনাবাহিনী মনে করছে, এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কমেছে।