Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 1:06 am

‘মুক্তভাবে পতনকালেও বিবেকবান মানুষ আত্মসচেতন থাকে’

আলী ওসমান শেফায়েত: অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সময়কালকে বোঝায়; যা ৬২২ সালে মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি শক্তির উত্থানের সময় থেকে শুরু হয়। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদ অবরোধের সময়কে এর শেষ ধরা হয়। ১৪৯২ সালে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের আন্দালুসে খ্রিষ্টান রিকনকোয়েস্টার ফলে গ্রানাডা আমিরাতের পতনকেও এর সমাপ্তিকাল হিসেবে গণ্য করা হয়।

আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের (৭৮৬-৮০৯) সময় বাগদাদে বাইতুল হিকমাহর প্রতিষ্ঠার ফলে জ্ঞানচর্চার প্রভূত সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফাতেমীয় যুগে (৯০৯-১১৭১) মিসর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, আফ্রিকার লোহিত সাগর উপকূল, তিহামা, হেজাজ ও ইয়েমেনের অন্তর্গত ছিল। এই যুগে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাণিজ্য ও শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। আরবরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিল। হারিয়ে যেতে থাকা অনেক ধ্রুপদি রচনা আরবি ও ফারসিতে অনূদিত হয়। আরও পরে এগুলো তুর্কি, হিব্রু ও লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিক, রোমান, পারসিয়ান, ভারতীয়, চৈনিক, মিসরীয় ও ফিনিশীয় সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তারা গ্রহণ, পর্যালোচনা ও অগ্রগতিতে অবদান রাখে।

স্বর্ণযুগের উত্থান ও কারণ: কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা আর জ্ঞান অর্জনের যথাযথ গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং জ্ঞান অর্জনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তৎকালীন মুসলমানদের জ্ঞান অর্জন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও শিক্ষালাভে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিল।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা: তৎকালীন ইসলামি সাম্রাজ্য জ্ঞানী-পণ্ডিতদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষক ছিল। সব খরচ রাষ্ট্র বহন করত। সে সময়ের ট্র্যান্সলেশন মুভমেন্ট বা তরজমা করার কাজে যে অর্থ ব্যয় হতো তার পরিমাণ আনুমানিক যুক্তরাজ্যের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের দুই বছরের বার্ষিক রিসার্চ বাজেটের সমান। হুনাইন ইবনে ইসহাকের মতো বড় জ্ঞানী ও অনুবাদকারীদের বেতনের পরিমাণ ছিল আজকালকার পেশাগত অ্যাথলেটদের বেতনের মতো। আব্বাসীয় যুগে আল মনসুর ইরাকের বাগদাদ শহরে ‘দ্য হাউস অব উইজডম’ নামে একটি বৃহৎ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত করেন।

পূর্ব সংস্কৃতির প্রভাব: মুসলিমরা জ্ঞানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা গ্রিক, পারস্য, ভারতীয়, চীনা, মিসরের সভ্যতার প্রাচীন জ্ঞানের বইগুলো আরবি ও পরে তুর্কিতে অনুবাদ করেন। উমাইয়া ও আব্বাসিয়া খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিক দার্শনিকদের কাজগুলো এবং বিজ্ঞানের প্রাচীন জ্ঞানগুলোকে সিরীয় ভাষা অনুবাদ করান; যা পরে আরবিতে অনূদিত হয়। তারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন দর্শন, বিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ দেখান। একটা লম্বা সময় ধরে আব্বাসীয় খলিফাদের চিকিৎসকরা ছিলেন আসারিয়ান খ্রিষ্টান। এদের মধ্যে বেশিভাগ খ্যাতনামা খ্রিষ্টান চিকিৎসক ছিলেন বুখতিশু বংশের।

চতুর্থ থেকে সপ্তম শতাব্দীজুড়ে গ্রিক এবং সিরিয়ান ভাষায় খ্রিষ্টান পণ্ডিতের কাজটি নতুনভাবে অনুবাদ হয়েছিল বা হেলেনীয় কাল থেকেই সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তখন জ্ঞানচর্চাও এবং প্রেরণের শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্রগুলোর মধ্যে খ্রিষ্টান স্কুলগুলো ছিল যেমন নিসিবিসের স্কুল, এডেসার স্কুল, পৌত্তলিক হারান বিশ্ববিদ্যালয় এবং খ্যাতিমান হাসপাতাল এবং মেডিকেল জুন্ডিশাপুর একাডেমি; যা প্রাচ্যের চার্চের বৌদ্ধিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র ছিল।

নব্য প্রযুক্তি: স্বর্ণযুগে কাগজের নতুনভাবে ব্যবহার বই রচনা ও জ্ঞানচর্চাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে মুসলিম অঞ্চলে কাগজের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল, দশম শতাব্দীতে ইবেরিয়ান উপদ্বীপের আল-আন্দালুস (আধুনিক স্পেন এবং পর্তুগাল) পৌঁছেছিল।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মুসলিম ব্যক্তিবর্গ : শিক্ষাক্ষেত্র: ইসলামিক ঐতিহ্য ও আচারানুষ্ঠান ছিল ধর্মশাস্ত্র ও ধর্মীয়গ্রন্থ কেন্দ্রিক। কোরআন, হাদিস এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসারতার কারণে মূলত তখন শিক্ষা ছিল ধর্মের প্রধান বুনিয়াদ এবং তা ইসলামের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ইসলাম ধর্মে শিক্ষালাভ ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বুঝাতে অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তির বচন উল্লেখ রয়েছে। এগুলো মধ্যে একটি হলো, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশ হলেও যাও। এই সংশ্লিষ্ট হাদিস এবং এ জাতীয় বিভিন্ন বিধিধারা বিশেষভাবে মুসলিম পণ্ডিতগণ এবং বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মাঝে প্রয়োগ ও প্রসার করতে দেখা গিয়েছিল। উল্লেখ্যস্বরূপ, শিক্ষা নিয়ে আল-জারনুজির একটি উক্তি ছিল, বিদ্যার্জন করা আমাদের প্রত্যেকের জন্য যথাবিহিত ও বাধ্যতামূলক। প্রাক-আধুনিক কালের ইসলামি সাম্রজ্যের শিক্ষার হার নির্ণয় করা অসম্ভব হলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তারা শিক্ষাক্ষেত্রে ও জ্ঞানার্জনে তুলনামূলকভাবে অনেক উচ্চস্তরে ছিল। বিশেষ করে তাদের সঙ্গে তৎকালীন ইউরোপীয় পণ্ডিতদের তুলনা করলে ইসলামিক পণ্ডিতদের জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা যায়।

সবাই ছোট বয়স থেকে শিক্ষার্জন করা শুরু করত আরবি এবং কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি হয়তো বাড়িতে না হয় কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেটা কোনো মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকত। তারপর অনেক শিক্ষার্থী তাফসির (ইসলামিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) এবং ফিকহ (ইসলামিক মাসায়ালা) বিষয়ে অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। এসব শিক্ষাকেও যথাযথ গুরুত্বের সহিত দেখা হতো। শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মুখস্থ করা কেন্দ্রিক। এছাড়া অগ্রগতিশীল মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাঠ্যগ্রন্থসমূহের প্রণেতা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পাঠক ও লেখক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এই প্রক্রিয়া সকল উচ্চাকাক্সক্ষী শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার জড়িত রাখত। ফলে উলামাদের তালিকায় তাদের সব ধরনের সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। একাদশ শতাব্দীর আগে এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকরূপ লাভ করেনি।  দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে শাসকদের দ্বারা মাদ্রাসা নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। যেখানে ইসলাম সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষার আলো ছড়ানো হতো। যখন মাদ্রাসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু পুরুষদের জন্য উš§ুক্ত ছিল, তখন নারীরা তাদের পরিবারে ব্যক্তিগণ তত্তাবধানে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। পরে তাদের হাদিস অধ্যয়ন, ক্যালিগ্রাফি আঁকা ও কবিতা আবৃত্তির শরিয়াহ সম্মত অনুমতি প্রদান করা হয়।

অধিবিদ্যা: ইবনে সিনা তার ভাসমান মানব পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, মুক্তভাবে পতনকালেও মানুষ আত্ম-সচেতন থাকে।

জ্ঞানতত্ত্ব: জ্ঞানতত্ত্বে, ইবনে তুফায়েল ‘হায় ইবন ইয়্যাকদান’ নামে উপন্যাস রচনা করেন এবং তার উত্তরে ইবনে আন নাফিস লিখেন ঞযবড়ষড়মঁং অঁঃড়ফরফধপঃঁং.

গণিতশাস্ত্র: গণিতশাস্ত্রের প্রচলন, অগ্রগতি ও উৎকর্ষতায় মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। যারা গণিতশাস্ত্রকে উন্নতির আসনে বসিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেÑআল বেরুনী, আল-খারেজমী, আল-কারখী, ওমর খৈয়াম, আবুল ওয়াদা প্রমুখ।

বীজগণিত: বীজগণিত, এলগরিদম এবং হিন্দু-আরবীয় সংখ্যার বিকাশ ও উন্নয়নে মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাকে বীজগণিতের জনক বলা হয়।

জ্যামিতি: ইসলামী শিল্পকলায় জ্যামিতিক প্যাটার্ন ও প্রতিসাম্যতা দেখা যায় বিশেষ করে দেয়ালের টাইলসে। সেগুলোতে রয়েছে দশভুজ, ষড়ভুজ, রম্বস এবং পঞ্চভুজের নানা রকম সমাবেশ। এদের প্রত্যেক বাহু ছিল সমান এবং সব কোণগুলো ৩৬ক্ক বা এর গুণীতক। ২০০৭ সালে পদার্থবিদ পিটার লু এবং পল স্টিনহাট প্রমাণ করেন ১৫ শতাব্দীর গ্রিল্থ টাইলসগুলো ছিল পেনরোজ বা গোলাপ কলম রকমের ডিজাইনকৃত।

ত্রিকোণমিতি: ইবনে মুয়াজ আল-জাইয়্যানি হলেন অন্যতম ইসলামিক একজন গণিতবিদ; যিনি সাইনের সূত্র আবিষ্কারের জন্য খ্যাত। ১১ শতকে তিনি “ঞযব ইড়ড়শ ড়ভ টহশহড়হি অৎপং ড়ভ ধ ঝঢ়যবৎব নামে একটি বই রচনা করেন। শুধু সমকোণী ত্রিভুজ ছাড়াও সাইনের এই সূত্রটি যেকোনো ত্রিভুজের বাহুদ্বয়ের দৈর্ঘ্যরে সাথে কোণদ্বয়ের সাইনের মানের সম্পর্ক গঠন করেছে।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি: হাসান ইবনে আল-হাইসাম হলেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ইতিহাসে পরীক্ষানির্ভর পদ্ধতির কারণে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

জ্যোতির্বিজ্ঞান: আনুমানিক ৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য জ্যোতির্বিদ আব্দুর রহমান আল সূফি তার রচিত ইড়ড়শ ড়ভ ঋরীবফ ঝঃধৎং গ্রন্থে এন্ড্রোমিডা কন্সটিলেশনের মধ্যে নীহারিকাবেষ্টিত স্থানের বর্ণনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম ওই স্থানের যথাযথ তথ্য প্রদান করেন এবং উদ্ধৃতি দেন যেটা এখন এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি নামে পরিচিত। যেটা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সবচেয়ে নিকটতম সর্পিলাকার গ্যালাক্সি। টলেমির সমস্যাযুক্ত ইকুয়্যান্ট সংশোধিত করতে নাসির আল দীন তুসী ‘তুসি কাপল’ নামে এক ধরনের জ্যামিতিক পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতি দ্বারা দুটি বৃত্তাকার গতির সারাংশ থেকে রৈখিক গতি সৃষ্টির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই তুসি কাপল পদ্ধতিটি পরবর্তীতে ইবনে আল-শাতিরের ভূ-কেন্দ্রিক মডেল এবং নিকোলাস কোপার্নিকাসের সূর্য-কেন্দ্রিক মডেলের উদ্ভাবন ও বিকাশে প্রয়োগিত হয়। যদিও এর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী কে ছিলেন বা কোপার্নিকাস নিজেই এই পদ্ধতি পুনরায় আবিষ্কার করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না।

পদার্থবিজ্ঞান: আল বিরুনী তার আলোকবিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে আলোর গতি শব্দের তুলানায় অসীম হতে পারে।

রসায়নশাস্ত্র: বিজ্ঞানের সর্ববৃহৎ ও প্রধান শাখার নাম রসায়ন। রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয় জাবির ইবনে হাইয়ানকে। রসায়নশাস্ত্রে বিভিন্ন মুসলিম মনীষী অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, খালিদ বিন-ইয়াজিদ, জাকারিয়া আল রাজী, আল-জিলদাকী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

ভূ-গণিত: আবু রায়হান আল বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮) প্রথম পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬৩৩৯.৬ কিমি (বর্তমান মান প্রায়. ৬৩৭১ কিমি) নির্ণয় করেন।

জীববিজ্ঞান: রক্তসংবহন তন্ত্র সম্পর্কিত ইবনে আন নাফিস তার ‘ঈড়সসবহঃধৎু ড়হ অহধঃড়সু রহ আরপবহহধ’ং ঈধহড়হ’ বইতে গ্যালেন স্কুলের রক্তপ্রবাহে, হƒদপিণ্ডর নিলয়গুলোর ভূমিকা সংক্রান্ত ভুলগুলো তুলে ধরেন।

সংখ্যাবাচক চিহ্ন: মুসলিম গণিতবিদ আল খারেজমী সর্বপ্রথম সংখ্যাবাচক চিহ্নের ব্যবহার বিষয়ে ধারণা দেন। গণিতশাস্ত্রের ওপর তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘কিতাবুল হিন্দ’। এখানে তিনি গণিতের বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমাধান দেখিয়েছেন।

দূরত্ব নির্ণয়: বিজ্ঞান ও গণিত জগতের এক অনন্য নাম ইবনুল হাইশাম। তিনিই প্রথম জ্যামিতিক গণনার সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করেন।

সমুদ্র সূর্য ও নক্ষত্র: মুসলিম বিজ্ঞানী আল-ফারাবি সর্বপ্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্র সমূহের উচ্চতা নির্ণয় করার আস্তারলব নির্মাণ করেন।

যৌগিক সূত্র আবিষ্কার: জাবির ইবনে হাইয়ান প্রথম এসিড, গন্ধক, দ্রাবক, জল দ্রাবক, রৌপ্যক্ষার ও অন্যান্য যৌগিক সূত্র আবিষ্কার করেন। তাছাড়া তিনি ভস্মীকরণ ও লঘুকরণকে বৈজ্ঞানিক নিয়মে আলোচনা করেছেন।

ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ: একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত রসায়নবিদ ইমাম জাফর আস-সাদিক সর্বপ্রথম রসায়নশাস্ত্রের আলোকে ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

ধাতুর পরিবর্তন: মুসলিম মনীষী আবুল কাশেম আল ইরাকি সর্বপ্রথম ধাতুর পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেন।

মানচিত্রের ধারণা: বিশ্ব মানচিত্রের প্রথম ধারণা দেন মুসলিম মনীষী আল-ইদ্রিসি। পরবর্তীতে এটিই বিশ্ব মানচিত্রের মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়।

বর্ষপঞ্জি ও নক্ষত্র: উমর খৈয়াম প্রথম বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে আল-বাত্তানি সর্বপ্রথম নক্ষত্রের চার্ট তৈরি করেন।

উদ্ভিদবিদ্যা: উদ্ভিদবিদ্যায় মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। উদ্ভিদবিদদের মধ্যে ইবনে বাতরের নাম উল্লেখযোগ্য। লতাপাতা সম্পর্কিত তাঁর তথ্যবহুল গ্রন্থটি আজও সকলের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাছাড়া মুসলমানরা ভূতত্ত্ব ও প্রাণিতত্ত্বে উন্নতি সাধন করেছিলেন।

প্রকৌশল: বনু মুসা ভ্রাতাগণ তাদের ‘বুক অব ইনজিনিয়াস ডিভাইস’ বইয়ে, এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় বাঁশির কথা উল্লেখ করেন; যা সম্ভত প্রথম প্রোগামসম্পন্ন যন্ত্র। বাঁশিতে বাষ্প ব্যবহার করে শব্দ তৈরি করা হতো আর ব্যবহারকারী তা প্রয়োজনমতো এক এডজাস্ট করতে পারত।

সামাজিক বিজ্ঞান: ইবনে খালদুনকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, হিস্টোগ্রাফির, জনমিতি ও অর্থনীতির জনক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

স্বাস্থ্যসেবা

হাসপাতাল: ইসলামী বিশ্বে প্রথম হাসপতাল প্রতিষ্ঠা খলিফা হারুন-অর-রশিদ কর্তৃক ৮০৫ সালে বাগদাদে। দশম শতাব্দীতে বাগদাদে ৫ গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল ছিল, সেখানে কর্ডোবাতেই ছিল ৫০টিরও বেশি হাসপাতাল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মিরসীয় গভর্নর আল মানসুর কালউন বিখ্যাত কালাউন হাসপাতাল তৈরি করেন; যেখানে একটি মসজিদ ও চেপেল ছিল, পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের জন্য আলাদা বিভাগ ও ডাক্তারদের জন্য গ্রন্থাগার ছিল। এটি চোখের চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার হতো। এখানে ৮০০০ রোগীর ধারণ ক্ষমতা ছিলÑপ্রতিদিন ৪০০০ গড়ে রোগীকে সেবা প্রদান করত।

ওষুধ: আবু বকর মোহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাযি প্রথম গুটিবসন্ত এবং হামের মাঝে পার্থক্য করেন; যা পূর্বে একটি রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আল জাহরাউযি? ছিলেন প্রথম কোনো চিকিৎসক যিনি অ্যাকোপিক গর্ভাবস্থার বর্ণনা দিয়েছিলেন এবং হেমোফিলিয়ার বংশগত প্রকৃতি চিহ্নিত করা প্রথম চিকিৎসক। পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে, রাযিকে একবার বাগদাদের নতুন হাসপাতালের জন্য জায়গাটি বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়েছিল, তিনি নগরীর বিভিন্ন স্থানে মাংসের টুকরো ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই স্থানে হাসপাতালটি তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল যেখানে মাংসে সবচেয়ে ধীরে ধীরে পচন ধরছিল।

চক্ষু চিকিৎসায়: চক্ষু চিকিৎসায় মুসলমানদের মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। আলি আল মাওসুলি চোখের ছানি অপারেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জর্জ সার্টনও তাকে জগতের সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসক বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। তার ‘তাজকিরাতুল কাহহালিন’ চক্ষু চিকিৎসায় সবচেয়ে দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ। এছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে হাসান ইবনে হাইসাম, আল বেরুনী, আলি ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাক, আবুল কাসেম জাহরাবি, জুহান্না বিন মাসওয়াই, সিনান বিন সাবিত, সাবিত ইবনে কুরা, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখও উল্লেখযোগ্য।

শল্যচিকিৎসা: আবুল কাসিম আল জাহরাউযি? হলেন ১০ম শতকের একজন ডাক্তার। তাকে মাঝে মধ্যে শল্যচিকিৎসার জনক বলা হয়।

অস্ত্রোপচার: মুসলিম বিজ্ঞানী আল-রাজী সর্বপ্রথম অস্ত্রোপচার বিষয়ে আধুনিক ভাবনা উদ্ভাবন করেন।

বাণিজ্য ও ভ্রমণ: অনেক মুসলমান ব্যবসার জন্য চীনে যায় এবং সাং রাজবংশের (৯৬০-১২৭৯) সময় আমদানি রপ্তানিতে তাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি তাবুলা রোজারিয়ানা তৈরি করেছিলেন, যা মধ্যযুগের সেরা মানচিত্র, বিভিন্ন পরিব্রাজক যেমন ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং ভাস্কো দা গামার আমেরিকা ও ভারতে তাদের ভ্রমণে ব্যবহার করেছিলেন।

শিল্প ও সংস্কৃতি

কবিতা: ১৩ শতকে পারস্য কবি রুমী অনেক বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন; যা আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিক্রীত কবিতাগুচ্ছের অন্যতম।

চারুকলা: পাণ্ডুলিপি আলোকসজ্জা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ছিল এবং পারস্যের ক্ষুদ্র চিত্রশিল্প পারস্যসীয় বিশ্বে সমৃদ্ধ হয়েছিল। পাণ্ডুলিপি এবং আর্কিটেকচারাল অলংকরণে লিখিত আরবীর একটি অপরিহার্য বিষয় ক্যালিগ্রাফি।

সংগীত: নবম ও দশম শতাব্দীতে আরবি সংগীতের উন্নয়ন ঘটে। দার্শনিক আল-ফারাবির উন্নয়ন সাধনে তত্ত্ব প্রধান করে। তার কাজ আন্দালুসিয়ার কোর্ট সংগীতকার জিরিয়াবের সংগীত অবলম্বনে ছিল। জিরিয়াব একজন খ্যাতনামা পলিম্যাথ ছিলেন, যার পাশ্চাত্য সভ্যতায় অবদানের মধ্যে ছিল নবম শতাব্দীর বিশ্ব সংগীতের দৃশ্যের আধিপত্য ছাড়াও আনুষ্ঠানিক খাবার, চুল কাটা, দাবা এবং আরও অনেক কিছু।

মধ্য এশিয়া ও আরবের চিন্তাবিদ এবং পলিম্যাথ সংগীতের ওপর মনোযোগ: সুমেরীয় ও আক্কাদিয়ানরা, গ্রিক এবং পার্সিরা সবাই গণিত ব্যবহার করে লুট, লিরেস এবং অন্যান্য স্ট্রিং যন্ত্রে ব্যবহƒত নোট তৈরি করত। একটি কাটা বা ধনুক করা স্ট্রিং একটি নোট উৎপাদন করে এই ধারণা ব্যবহার করে, তারা একটি স্ট্রিং থামানোর সময় স্বরের পার্থক্য লক্ষ্য করে। মহান আবিষ্কার দ্বৈত অষ্টভুজের শব্দ শুনছিল, যে একটি স্ট্রিং অর্ধেক একটি সুরের ওপর একটি নোট উৎপাদন করে।

মধ্য এশিয়া এবং আরবের মিশ্র সংস্কৃতি বেশ কয়েকজন চিন্তাবিদের জš§ দেয় যারা সংগীত নিয়ে লিখেছেন, তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে আল-কিন্দি (আনু. ৮০১-৮৭৩), জিরায়াব (৭৮৯-৮৫৭), আল-ফারাবি (আনু. ৮৭২-৯৫০), ইবনে সিনা (আনু. ৯৮০-১০৩৭) এবং সাফি আল-দিন আল-উরমাউযি? (১২৪৬-১৩১৬)। তারা আরবি ভাষায় লিখেছে, যা তাদের সময়ের দরকারি লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হয়ে উঠেছিল এবং মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিতে অংশ হয়ে গিয়ে ছিল। যাই হোক তারা মধ্য এশিয়ায় আনা হয়।

আরবদের একটি সংগীত স্কেল ছিল, যা আল-ফারাবি দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে কেউ কেউ ব্যবহার করে। যে তানবার স্কেল, যা স্ট্রিংকে ৪০টি সমান অংশে”বিভক্ত করেছে, তা হয়তো বাবিল এবং আসিরিয়ার অবশিষ্ট অংশ। যাই হোক, আরবরা পারস্যদের সঙ্গে বাণিজ্য এবং জয় করে এবং তারা তাদের বাদ্যযন্ত্রের জন্য ফার্সি পাল্লা গ্রহণ করে, ঠিক যেমন তারা ফার্সি শর্ট-নেকড লুট দত্তক নেয়।

জিরায়াব বাগদাদ থেকে আল-আন্দালুসের দিকে চলে যান, যেখানে তিনি একটি সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং প্রথম তিনি একটি পঞ্চম স্ট্রিং বা কোর্স যোগ করেন, (৮২২ থেকে ৮৫২-এর মধ্যে)। আল-আন্দালুস, যেখানে তিনি বসতি স্থাপন করেছিলেন তা ইউরোপের জন্য বাদ্যযন্ত্র উন্নয়নের একটি কেন্দ্রে পরিণত হবে।

স্থাপত্য: তিউনিসিয়ার কাইরুয়ান জামে মসজিদ হলো পশ্চিমা মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটি ৬৭০ সালে আরব সেনানায়ক উকবা ইবনে নাফি কর্তৃক কাইরুয়ান নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পতনের কারণ

অর্থনীতি: ইসলামি বিজ্ঞানের পতনের জন্য, যুক্তি দেয়া হয়েছে যে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে সুন্নি পুনরুজ্জীবন বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সৃষ্টি করেছে; যা বৈজ্ঞানিক কাজ উৎপাদনের আপেক্ষিক অর্থ হ্রাস করেছে। মাদ্রাসা বিস্তার এবং ধর্মীয় নেতাদের বৃহত্তর প্রভাব সঙ্গে, এটি ধর্মীয় জ্ঞান উৎপাদন আরও লাভজনক হয়ে ওঠে।

আহমেদ ওয়াই আল-হাসান এই তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছেন যে সৃজনশীল চিন্তার অভাব একটি কারণ, এই যুক্তিতে যে বিজ্ঞানকে সবসময় ধর্মীয় যুক্তি থেকে আলাদা রাখা হয়; এর পরিবর্তে তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের পতন বিশ্লেষণ করেন, যা চতুর্দশ শতাব্দীর লেখক ইবনে খালদুনের কাজের ওপর আঁকা। আল-হাসান স্বর্ণযুগকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত প্রসারিত করেন, উল্লেখ করেন যে বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ ততদিন পর্যন্ত বিকশিত হতে থাকে। আরও বেশ কয়েকজন সমসাময?িক পণ্ডিত ও ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এটি প্রসারিত করেছেন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতে পতন বিশ্লেষণ করেছেন। সাম্প্রতিক গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে যে সপ্তদশ শতাব্দীতে যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ওপর উৎপাদিত কাজের পুনরুজ্জীবনের উদ্ধৃতি দিয়ে সে সময়েও এর পতন ঘটেছে।

বহিরাক্রমণ: ইবনে খালদুনের মতে, মুসলিমদের অধিকৃত বাণিজ্য পথগুলো মঙ্গোলদের আক্রমণের কারণে হারিয়ে যায়। হালাকু খান কর্তৃক ১২৫৮ সালে বাগদাদ ও বাইতুল হিকমাহ ধ্বংসের পর থেকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিমদের পতন ঘটে বলে অনেকে মনে করেন। ১৫১৬-১৭ সালে আরবিভাষী মধ্য প্রাচ্যের অটোমান বিজয় ইসলামি বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রকে অটোমান তুর্কিরা নিয়ন্ত্রণে রাখে। অটোমান আমলেও বিজ্ঞান মধ্যপ্রাচ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

উপসংহার: মুসলিম স্বর্ণযুগে মুসলমানদের বিভিন্ন আবিষ্কার, গবেষণাকর্ম ও সূত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধশালী। এ সময় বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান বর্ণনাতীত। যদিও মুসলমানদের কৃতিত্বের অনেক কিছুই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাদ পড়েছে। কিন্তু এ কথা সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে মুসলমানরা আধুনিক বিজ্ঞানের সফল পথিকৃৎ।

আমরা কি পারিনা ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেতে, মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ও আবিষ্কার নিয়ে কথা বলতে? আমাদের শিশু-কিশোররা যখন তাদের পূর্বপুরুষদের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং অর্জনগুলো সম্পর্কে জানবে, তখন তাদের মধ্যে আর হীনমন্যতা কাজ করবে না। এই ইতিহাস আর গল্পগুলো তাদের অনুপ্রাণিত করবে দারুণভাবে। হলিউড, বলিউডের নায়ক-নায়িকা, গায়ক বা সেলিব্রিটি খেলোয়াড় কিংবা তথাকথিত টিকটক সেলিব্রিটিদের বদলে খোঁজে পাবে তার আসল আদর্শকে। তখন ইবনে সিনা, ছাবেত ইবনে কোরা, ওমর খৈয়ামরা হবে তাদের আইডল।

শিক্ষক ও গবেষক

কুতুবদিয়া, কক্সবাজার