কয়েক'শ নারী-পুরুষের জটলা

মুন্সীগঞ্জের বাজারগুলোতে প্রতিদিন বসছে শ্রম বিক্রির হাট

oplus_2

প্রতিনিধি, মুন্সীগঞ্জঃ বালিগাঁও বাজার, মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ি ও লৌহজং উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি বাজার। সকাল পৌনে ৬টার দিকে ওই বাজারে সড়কের দুই পাশে কয়েক শতাধিক নারী ও পুরুষের জটলা পাকিঁয়ে দাড়িয়ে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ল, দুর থেকে দেখলে সকলেরই মনে হবে কিছু একটা হয়েছে সেখানে। এগিয়ে কাছে গিয়ে জানা গেলো, সেখানে কিছুই হয়নি। মানুষের ভীড় থাকা স্থানে দাড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। তারা জীবিকার তাগিদে এ অঞ্চলে এসেছে আলু রোপন কাজে। প্রতিদিন সকালের ন্যায় বৃহস্পতিবার সকালেও শ্রম বিক্রি বেচাকেনার হাট বসেছে দুই উপজেলার মধ্যস্থল বালিগাঁও বাজারের ওপর দিয়ে বয়ে চলা সড়কে। এ জন্যই সেখানে কয়েক শতাধিক নারী ও পুরুষের ভীড় জমেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টঙ্গিবাড়ীর বালিগাঁও বাজারের মতো মুন্সীগঞ্জ জেলার ৬৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ও হাট-বাজার গুলোতে প্রতিদিন ভোর সকালে নিলফামারী,
গাইবান্ধা, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত পুরুষ ও নারী শ্রমিকের শ্রম বিক্রির বেচাকেনার হাট বসে থাকে। চুক্তি অনুযায়ী অথবা দিন প্রতি পারিশ্রমিকে চুক্তিবদ্ধ হয়েই আলু রোপন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এসব শ্রমিকরা।

স্থানীয় শ্রমিক সঙ্কটের কারনে কৃষকরাও উত্তরবঙ্গের এসব শ্রমিকদের পেয়ে আলু রোপন কাজে তাদেরকে সম্পৃক্ত করছে। আর এই শ্রমিকরাই কয়েক মাস পর জমি থেকে আলু উত্তোলন শেষে তা বস্তায় ভরে হিমাগারে ও কৃষকের বাড়ির আঙ্গিনায় পৌছে দেওয়ার কাজ করবে। তাই জেলার গ্রামে গ্রামে এখন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের পদচারনায় মুখর।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল পৌনে ৬টা। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর বালিগাঁও বাজারে সড়কের দু’পাশে দেখা গেল অসংখ্য নারী-পুরুষের জটলা। কৃষি জমির মালিকদের সঙ্গে দেনদরবারে ব্যস্ত শ্রমিকরা। কেউ পেশাদার, কেউবা আবার অপেশার শ্রমিক হিসেবে এ শ্রম বিক্রির হাটে এসেছে। তারা একেকজন একেক পেশায় শ্রমিক বা দিনমজুর। এখান থেকে কেউ একজন, কেউ আবার একের অধিক শ্রমিক দর কষাকষির মাধ্যমে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পারিশ্রমিকে কিনে নিচ্ছে। কেউ বাড়ির কাজে, কেউ ক্ষেত-খামারে, কেউবা আবার আলু রোপণ করবে। মূলত আলু রোপণ ও উত্তোলন মৌসুমে দেশের উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে জীবিকার তাগিদে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক আসে মুন্সীগঞ্জ জেলায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টার এই হাটে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শত শত শ্রমিকদের শ্রম বিক্রি হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে। বালিগাঁও বাজার ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের শ্রম বিক্রির হাট বসে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘিরপাড় বাজার, আলদী বাজার, হাসাইল বাজার, বেতকা বাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুক্তারপুর, মুন্সীরহাট বাজার, চিতলিয়া বাজার, চরডুমুরিয়া বাজার, শিলই, বাংলাবাজার, মদিনা বাজার, গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর বাসস্ট্যান্ড, সিরাজদীখান উপজেলার নিমতলা, ইছাপুরা চৌরাস্তা, বালুচর, লৌহজং উপজেলার হলদিয়া বাজার, মাওয়া চৌরাস্তা, শ্রীনগর উপজেলার চকবাজারসহ আরও একাধিক স্থানে। এ হাটগুলোতে দর কষাকষি করে কেনাবেচা হয় মানুষের শ্রম। সকাল ৬টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এ দুই ঘণ্টা হাটে মানুষের শ্রম বেচাকেনা হয়। এ হাটে আসেন কেউ ৭ দিনের জন্য, কেউ আবার এক মাসের জন্য। আবার কেউ কেউ পুরো মৌসুমের জন্য বিক্রি হয়।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলু আবাদ মৌসুম এলেই দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নিলফামারী, ময়মনসিংহ, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক আসে মুন্সীগঞ্জ জেলায়। আর আগত এসব শ্রমিকরা আলু রোপন কাজে যুক্ত হতে প্রতিদিন ভোর সকালে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে জড়ো হচ্ছেন। চুক্তি হওয়ার পর তারা কৃষকের সঙ্গে জমিতে আলু রোপন কাজ শুরু করে দিচ্ছেন।

কৃষকরা আরও জানান, শুধু আলু তোলা নয়, কৃষির অন্যান্য ফসলের কাজে এদের শ্রম কাজে লাগে। চুক্তি এবং দিনপ্রতি পারিশ্রমিকে চুক্তিবদ্ধ হয়েই ফসলের মাঠে কাজে ছুটছেন এ সব শ্রমিক। কৃষকরা স্থানীয় শ্রমিকের অভাবে উত্তরবঙ্গের এই শ্রমিকদের পেয়ে ফসলের মাঠে তাদেরকে সম্পৃক্ত করছেন।

গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর থেকে আসা শ্রমিক তাইবুর হোসেন বলেন, বর্তমানে আমাদের গ্রামের বাড়িতে কোনো কাজকর্ম নেই। তাই মুন্সীগেঞ্জ ছুটে এসেছি আমরা ছয়জন। এক আলু চাষির সঙ্গে কথা হয়েছে। সে এক মাসের জন্য আমাদের নিবে এবং প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে দিবে।

রৌমারী থেকে আসা সুজন মিয়া বলেন, কৃষি কাজই আমাদের আয়ের একমাত্র মাধ্যম। এই সময়টাতে আমাদের ওখানে কোনো কাজ থাকে না তাই সিরাজদিখানে এসেছি। কয়েকজনের সঙ্গে দরকষাকষি চলছে।

ইমামগঞ্জ এলাকার আলু চাষি মনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের এ অঞ্চলে শ্রমিক সংকট, তাই নিমতলা এসেছি। আলুর জমি প্রস্তুত করার জন্য ১০ জন শ্রমিক নিয়েছি। থাকা ও খাওয়াসহ দিন হাজিরা ৫০০ টাকা।

সিরাজদীখানের ইছাপুরার আলুচাষী ইসমাইল মিয়া জানান, একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। ইছাপুরা ইউনিয়নের ইছাপুরা চৌরাস্তা থেকে আলু রোপন করার জন্য ৬ জন শ্রমিক ক্রয় করেছেন।

একই উপজেলার নিমতলা এলাকার আলু চাষী তোফাজ্জল হোসেন জানান, তার জমিতে আলু রোপণ করতে উত্তরবঙ্গের শ্রমিক নিয়োগ করেছেন। আমাদের এ অঞ্চলে শ্রমিক সংকট তাই নিমতলা হাটে আলুর রোপনের জন্য ২০ জন শ্রমিক নিয়েছি। থাকা ও খাওয়াসহ দিন হাজিরা ৫০০ টাকা।

ইছাপুরার আলুচাষী কাজল বেপারী জানান, একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। ইছাপুরা ইউনিয়নের ইছাপুরা চৌরাস্তা থেকে অলু বপনের জন্য ৬ জন শ্রমিক ক্রয় করেছি। থাকা খাওয়াসহ দিনপ্রতি ৫০০ টাকা করে প্রত্যেককে দিতে হবে।

বরিশাল থেকে আশা অপর শ্রমিক দেলোয়ার মিয়া বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের গ্রামের বাড়িতে কোনো কাজকর্ম নেই। তাই কাজের জন্য এই এলাকায় ছুটে এসেছি আমরা ৬ জন। এক আলু চাষির সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি এক মাসের জন্য আমাদের নিবেন দৈনিক ৫০০ টাকা করে দিবে বলেছে।

মাদারীপুর থেকে আসা রাজন বেপারী বলেন, ‘কৃষিকাজই আমাদের আয়ের একমাত্র মাধ্যম। এই সময়টাতে আমাদের ওখানে কোন কাজ থাকে না তাই সিরাজদিখানে এসেছি। কয়েকজনের সঙ্গে দরকষাকষি চলছে।

মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, “এ মৌসুমে জেলায় ৩৪ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার বিস্তীর্ণ জমিতে আলু রোপনের উৎসব চলছে। তিনি জানান, এ জেলার বিভিন্ন বাজারে শ্রম বিক্রির হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত শ্রমিকরা প্রতিদিন সকালে কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করে তারা শ্রম বিক্রি করছে।