অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ: বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন। তাদের মধ্যে কোনো কোনোটি কয়েকশ বছরের পুরোনো। এমনই একটি নিদর্শন হলো সিরাজগঞ্জ জেলার শেষ প্রান্তের উপজেলা শাহজাদপুরে করতোয়া নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত মখদুমিয়া শাহদৌলা (রহ.) জামে মসজিদ।
বাংলার সুলতানি আমলে হযরত মখদুম শাহদৌলা শহীদ ইয়ামেনি (রহ.) এর নির্দেশে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩১ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৬ ফুট ২ ইঞ্চি। মসজিদের বাইরের দৈর্ঘ্য ৬২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ৪১ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ১৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেয়াল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু। মোট ৫টি দরজা রয়েছে এই মসজিদের। প্রতিটি দরজার উচ্চতা ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৬ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি। মোট গম্বুজের সংখ্যা ১৫টি।
মসজিদটির মেঝে থেকে গম্বুজের শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতা ২০ ফুট ৯ ইঞ্চি। ছোট ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটিকে ধারণ করে রেখেছে কালো পাথরের মোট ২৪টি স্তম্ভ। বর্তমানে এ ঐতিহ্যবাহী মসজিদের নাম ‘মখদুমিয়া জামে মসজিদ।’ মসজিদের বাইরে এবং ভেতরে প্রধানত ফলমূল ও লতাপাতার কারুকার্য রয়েছে। এই মসজিদ ঘিরে ইসলামের প্রচারণা চলে সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে।
কথিত আছে, ইয়েমেনের শাহজাদা হজরত মখদুম শাহদৌলা শহীদ ইয়ামেনি রহ: ১১৯২-৯৬ সালের মধ্যে ইয়েমেন থেকে ধর্মপ্রচারার্থে যাত্রা শুরু করে বোখারা শহরে আগমন করেন। বোখারা শহরে হজরত জালাল উদ্দিন বোখারি রহ-এর দরবার শরিফে কিছু সময় অতিবাহিত করে তিনি বাংলার পথে যাত্রা শুরু করে বাংলার শাহজাদপুর অঞ্চলে আসেন। তিনি বাংলায় প্রবেশ করে ইসলাম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন সুবা বিহারের অমুসলিম অধিপতি রাজা বিক্রম কেশরী হজরত মখদুম শাহদৌলার আগমনে রাগান্বিত হয়ে তার সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। সর্বমোট ৩৩ বার মখদুম শাহদ্দৌলার (রহ.) সঙ্গে যুদ্ধ হয় তার। শেষ যুদ্ধে পরাজিত বন্দিদের একজন গুপ্ত ঘাতক ইসলাম ধর্ম গ্রহণের নামে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.)-এর অত্যন্ত কাছে স্থান লাভ করে। পরে একদিন হযরত মখদুম শাহদৌলাকে (রহ.) নামাজ পড়া অবস্থায় হত্যা করে পালিয়ে যায় ওই গুপ্তঘাতক। হযরত মখদুম শাহদৌলার (রহ.) কাটা মস্তক যে স্থানে সমাহিত করা হয় তা ‘ছের মোকাম’ বলে পরিচিত। অন্যদিকে, হযরত মখদুম শাহদৌলার (রহ.) দেহ মোবারক শাহজাদপুর মসজিদের দশ রশি দক্ষিণে দাফন করা হয়। দরগাহপাড়ার এই স্থানটিতেই মখদুম শাহদৌলা রহ: তার অনুসারী এবং ওস্তাদ শামসুদ্দিন তাবরিজিকে নিয়ে পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করতেন। ধীরে ধীরে এখানে গড়ে তোলেন জামে মসজিদ। তখনকার ওই মসজিদটি ‘মখদুমিয়া জামে মসজিদ’ হিসেবেই পরিচিত লাভ করে।
পরে ১৫০০-১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মুসলিম সুলতানি আমলে এ মসজিদের পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তৎকালীন মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম কারুকার্য ব্যবহার করা হয় মসজিদ নির্মাণ কাজে। ১৫ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্য ১৩.১৯ মিটার, পূর্ব-পশ্চিম প্রস্থ ১২.৬০ মিটার এবং ছাদের উপরিভাগের গম্বুজের ব্যাস ৩.০৮ মিটার। গম্বুজের প্রতিটি মাথায় পিতলের কারুকার্যমণ্ডিত, যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এটিই এই অঞ্চলের মুসলমানদের প্রথম বা বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন।
এখন পর্যন্ত সর্বমোট দুইবার এ মসজিদটি সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের পাশে মখদুম শাহদ্দৌলা (রহ.)-এর কবরের ওপরে বিশাল আকৃতির গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে মসজিদটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংরক্ষণ ও দেখাশোনা করা হয়। মখদুমিয়া জামে মসজিদের দক্ষিণে প্রতি বছরের চৈত্র মাসে দু’দিনব্যাপী ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ওরশে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাগম ঘটে।
মখদুমিয়া জামে মসজিদ ও মাজারে যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে বাসে করে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা সদরের বিসিক বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে রিকশা অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যাওয়া যাবে মখদুমিয়া জামে মসজিদে।
মসজিদের খাদেম মাওলানা মো. হাফেজ বলেন, ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় মখদুমিয়া জামে মসজিদটি তৈরি হয়েছে। আমি এই মসজিদে খেদমত ও নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করি। এই মসজিদে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ নামাজ পড়তে এবং মানত করতে আসেন। মসজিদটির সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগের বিশেষ নজর দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
মসজিদের ইমাম মো. আকবর আলী জানান, ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ওলি, আউলিয়া ও দরবেশসহ অনেকেই এখানে আগমন করেছেন। তাদের তৈরি করা আল্লাহ ঘর এই মখদুমিয়া জামে মসজিদে আমি দীর্ঘদিন ধরে ইমামতি করছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মুসল্লি অনেক বেশি হয়। তবে শুক্রবার মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে যায়। অনেক সময় নামাজের জায়গা দিতে পারি না।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন বলেন, মখদুমিয়া জামে মসজিদটি প্রাচীন নিদর্শন। জেলার যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। মসজিদের নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষায় সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।