Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 10:25 pm

মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম বিকৃতি ও মুছে দেয়া অতীত ইতিহাস

 

আলী ওসমান শেফায়েত: ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ও ঈর্ষণীয় সাফল্য তৎকালীন সময়ের পুরো পৃথিবী অবলোকন করেছে, যা আজ সূর্যের আলোর মতো দেদীপ্যমান। পরে তাদের সবধরনের গবেষণাকর্ম ও বইপত্র ল্যাটিনসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তবে অনূদিত গ্রন্থগুলোতে সুপরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিজ্ঞানীদের নামও ল্যাটিনে অনুবাদ করা হয়েছে। অথচ পৃথিবীর যেকোনো ভাষায় কোনো লেখকের বই বা গবেষণাকর্ম অনুবাদ করলে কেবল বইয়ের বিষয়বস্তু অনুবাদ করা হয়, লেখকের নাম নয়।

ইউরোপীয়দের মতো লেখকের নাম অনুবাদ করার এমন অদ্ভুত উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর সব দেশের কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের নাম অক্ষত রেখে অনুবাদকর্ম সম্পাদন করা হলেও ইসলামের স্বর্ণযুগের মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের নাম অক্ষত রাখা হয়নি, যা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ।

ল্যাটিন ভাষায় মুসলিম পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের নাম বিকৃত করার এই হীন প্রচেষ্টার কথা অধ্যাপক জি সারটন তার ‘ইন্ট্রডাকশন টু দ্য হিস্টোরি অব সায়েন্স’ বইয়ে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘সংক্ষেপে বলতে গেলে, অত্যন্ত দুর্বল সূত্রের ওপর জোর দেয়ায় এবং পশ্চিমা ধ্যানধারণার প্রতি একান্তভাবে অনুগত থাকায় ইতিহাসবিশারদরা মধ্যযুগের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদের পুরোপুরি মিথ্যা ধারণা দিয়েছেন। মধ্যযুগেই মুসলিম বিশ্ব শ্রেষ্ঠতম অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ না করে, বরং এ ধারণাকে আরও জোরালো করতে সক্ষম হয়েছেন। এ যুগ আমাদের বর্তমান পৃথিবীর অজ্ঞতার চেয়ে বেশি অন্ধকার ছিল না।” বিষয়টি আরও পরিষ্কার ধারণা দিতে গিয়ে অধ্যাপক জি সারটন একই গ্রন্থে বলেন, ‘মধ্যযুগ যে অন্ধকার যুগ নয়, তা প্রমাণ করতে মুষ্টিমেয় কিছু নাম উচ্চারণ করাই যথেষ্ট হবে।

সমসাময়িককালে পশ্চিমা বিশ্বে তাদের সমতুল্য কেউ ছিল না। তারা হলেন, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল-কিন্দি, আল-খাওয়ারিজমি, আল-ফরগানি, ইব্রাহিম ইবনে সিনান, হুনায়ন ইবনে ইসহাক, আল-ফারাবি প্রমুখ। কেউ যদি বলে, মধ্যযুগ ছিল অন্ধকার যুগ। তবে এ নামগুলো তার সামনে উচ্চারণ করুন। আশা করি, সে তার উত্তর পেয়ে যাবে।’

মুসলিম বিজ্ঞানীদের আরবি গ্রন্থগুলো ইউরােপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হলেও গ্রন্থকারের ল্যাটিন নাম দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তারা মুসলমান। প্রত্যেক মুসলিম গ্রন্থকারের নাম আরবিতে দীর্ঘ হলেও ল্যাটিন ভাষায় তাদের নাম দেয়া হয়েছে একটি মাত্র শব্দে।

কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানীর বিকৃত করা নাম
ইবনে সিনা: চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃতি করে রাখা হয়েছে ‘অ্যাভিসিনা’ (আরপবহহধ)।

আল-খাওয়ারিজমি: বীজগণিতের জনক আল-খাওয়ারিজমির পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি। ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃতি করে রাখা হয়েছে ‘গরিটাস’ বা ‘এলগোরিজম’ (অষমড়ৎরংস)।

ইবনে বাজ্জাহ: প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ, যুক্তিবিদ, দার্শনিক, পদার্থবিদ, মনোবিজ্ঞানী ইবনে বাজ্জাহর পুরো নাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে আস-সাইগ আত-তুজিবি ইবনে বাজ্জাহ। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার বিকৃত নাম ‘অ্যাভামপেস’ (আবসঢ়ধপব)।

আল-ফরগানি: নবম শতাব্দীর খ্যাতনামা মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল-ফারগানির পুরো নাম আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে মোহাম্মাদ ইবন কাসির আল-ফারগানি। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম ‘আলফ্রাগানাস’ (অষভৎধমধহঁং)। চাঁদের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আলফ্রাগানুসের নামকরণ তার নামেই করা হয়েছে।

আল-ইদ্রিসি: পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র অঙ্কনকারী ও মুসলিম ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসির পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রিস আল-শরীফ আল-ইদ্রিসি। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম ‘দ্রেসেস’ (উৎবংবং) নামে পরিচিত।

জাবির ইবনে হাইয়ান: কেবল চিকিৎসা বিষয়ের ওপর ৫০০ গ্রন্থের প্রণেতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ তথা রসায়ন বিজ্ঞানের জনক জাবির ইবনে হাইয়ানের পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার বিকৃত নাম ‘জেবার’ (তবনবৎ)।

আল-কিন্দি: কুরআন, হাদিস, ফিক্বাহ, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি নানা বিষয়ের বিশারদ আল-কিন্দির পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি। যিনি আল-কিন্দি নামেই পরিচিত। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম ‘আলকিন্ডাস’ (অষশরহফঁং)।

আল-বাত্তানী: সৌরবর্ষ নির্ণয়ে আল-বাত্তানী সর্বাধিক পরিচিত। তিনিই প্রথম নির্ভুলভাবে পরিমাপ করে দেখিয়েছেন যে, এক সৌর বৎসরে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড হয়, যার সঙ্গে আধুনিক পরিমাপের পার্থক্য মাত্র ২ মিনিট ২২ সেকেন্ড কম। এছাড়া ত্রিকোণমিতির সাইন, কোসাইন, ট্যানজেন্ট, কোট্যানজেন্ট ইত্যাদির ধারণাও তিনি দিয়েছেন। এমনকি সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ নিয়ে টলেমি যে মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, আল-বাত্তানি তা থেকেও নির্ভুল তথ্য প্রদান করেন। তার পুরো নাম ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাক্কি আল হারানী আস সাবী আল-বাত্তানী। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার পরিচয় ‘আল-বাতেজনিয়াজ’, ‘আল বাতেজনি’, ‘আল-বাতেনিয়াজ’ ইত্যাদি নামে।

আবু বকর আল রাজী: আবু বকর মুহম্মদ ইবনে যাকারিয়া আল রাজীর নাম কে না জানে। তিনি একাধারে একজন পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, দার্শনিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি প্রায় ২০০ এর মতো গ্রন্থ রচনা করেন, যার শ’খানেকই চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর। তবে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে ‘আল জুদায়ী ওয়াল হাসবাহ’ নামক গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষাতেই ১৪৯৮ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত এই গ্রন্থখানা মোট চল্লিশবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ‘কিতাব আল মনসুরী’ নামে দশ খণ্ডে একটি বিরাট চিকিৎসা গ্রন্থও প্রণয়ন করেন। সালফিউরিক এসিডের আবিষ্কারক এই মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম ইউরোপীয়রা ল্যাটিন ভাষায় বিকৃত করেছে ‘রাজেস’ বা ‘রাজিজ’ নামে।

ইবনে রুশদ: পুরো নাম আবুল ওয়ালিদ মুহম্মদ ইবনে আহ্মদ ইবনে রুশদ। তিনি ইবনে রুশদ নামে বেশি পরিচিত। তিনি একজন আন্দালুসীয়ান (স্পানিস) মুসলিম বিজ্ঞানী। তিনি একাধারে ইসলামিক দার্শনিক, ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ, যুক্তিবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ, পদার্থবিদ ছিলেন। তার নাম পাশ্চাত্য গ্রন্থগুলোর বিকৃত করে রাখা হয়েছে ‘এভেরুশ’ (আবৎৎড়বং) নামে।

আল-ফারাবি: দ্বিতীয় শিক্ষক খ্যাত প্রখ্যাত মুসলিম পদার্থবিজ্ঞানী, যুক্তিবিদ, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজবিদ, মহাকাশবিদ আবু নসর মুহম্মদ বিন মুহম্মদ আল ফারাবি। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম ‘শূন্যতা’র অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃত করে রাখা হয়েছে ‘আল ফারাবিয়াস’।

হাসান ইবনুল হায়সাম: আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক প্রখ্যাত পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী, গণিতবিদ, চিকিৎসাবিদ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী আবু আলি হাসান ইবনে হাসান ইবনে হায়সাম। কিন্তু ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃত করে রেখেছে ‘আল হ্যাজেন’ (অষযধুবহ)।
ইমাম গাজ্জালী: পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ তথা বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবনকারী ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ তুসী আল-গাজ্জালী ছিলেন একাধারে একজন প্রভাবশালী ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, আইনবিদ, যুক্তিবিদ মহাকাশবিদ, মনোবিজ্ঞানী। মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এই দার্শনিকের নাম ল্যাটিন ভাষায় বিকৃতি করে রাখা হয়েছে ‘আল গ্যাজেল’।

শুধু ইবনে সিনা, আল-খাওয়ারিজমি, ইবনে বাজ্জাহ, আল-ফরগানি, আল-ইদ্রিসী, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল-কিন্দি কিংবা আল-বাত্তানী নয়, বলতে গেলে সব মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদের নাম করে সুপরিকল্পিতভাবে বিকৃত করা হয়েছে। আরও আছেন আবু বকর আল-রাজী, ইবনে রুশদ, আল-ফারাবী, হাসান ইবনুল হায়সাম, ইমাম গাজ্জালী প্রমুখের নাম।

মুসলিম বিজ্ঞানীদের শুধু নামের বিকৃতি নয়, খোদ তাদের পরিচয় নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাদের কারও কারও ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তারা আদৌ মুসলমান নন, ইহুদি কিংবা ইউরোপীয়। রসায়নের জনক জাবির হাইয়ান এমন এক অপপ্রচারের শিকার। ইউরোপের কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করছেন, জাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়া আরেকজন জাবির ছিলেন। তার নাম ‘জিবার’ এবং এ জিবার হলেন ইউরোপীয়।

বীজগণিতের জনক আল-খাওয়ারিজমি সম্পর্কেও অনুরূপ কথা বলা হচ্ছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাকে জরোস্ত্রীয় হিসাবে দাবি করছেন। খাওয়ারিজমির বিপরীতে আরেকজন ‘খাওয়ারিজমি’র অস্তিত্ব আবিষ্কার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে দ্বিতীয় খাওয়ারিজমি হলেন গণিতে প্রথম শূন্য ব্যবহারকারী।
পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়কারী আলফরগানিও ষড়যন্ত্রের শিকার। তার পরিচয় নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বলা হচ্ছে, ফরগানি হলেন দু’জন।

এমনি আরো কতভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান অস্বীকার অথবা তাদের অবদানকে খাটো করার হীন চক্রান্ত চালানো হচ্ছে তার শেষ নেই। আমরা সবাই একনামে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও ও নিউটনের মতো ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চিনি। চিনি না কেবল তাদের গুরু ইবনে বাজ্জাহ, ইবনে রুশদ অথবা নাসিরুদ্দিন তুসিকে। আমরা না চিনলেও ইতিহাস থেকে তারা হারিয়ে যাবেন না। বিজ্ঞান যতদিন টিকে থাকবে মুসলিম বিজ্ঞানীরাও ততদিন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন।

শিক্ষক ও গবেষক
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার