মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন আঙ্গারপাড়া মসজিদ

তৈয়ব আলী সরকার, নীলফামারী: কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না মসজিদটি কবে ও কে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তবে এর অনুপম সৌন্দর্যে একটুও ছেদ পড়েনি। আসলেই মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হয়ে রয়েছে আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ী জামে মসজিদটি।

নীলফামারী সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের আঙ্গারপাড়া বড়বাড়ী নামে পরিচিতি লাভ করে মসজিদটি। কিন্তু এর নির্মাণকাল সম্পর্কে পরিষ্কার জানা নেই কারও। জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পূর্ব দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে মসজিদটি। বাইরে থেকে দেখা যায় তিন গম্ভুজ-বিশিষ্ট ও আটটি মিনার রয়েছে। মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় তিন ফুট দৈর্ঘ্য আর দুই ফুট প্রস্থের তিনটি দরজা। মাঝের দরজার ওপর পাথরে খোদাই করা (শিলালিপি) আরবিতে লেখা।

ওই মসজিদের মোয়াজ্জিন মো. শফিকুল ইসলাম (৫৫) জানান, ওই আরবি লেখা ফলকটিতে মসজিদের ইতিহাস বলা আছে। কিন্ত ফলকনামাটি অনেক পুরোনো হওয়ায় কিছুটা ক্ষয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ২১ বছর ধরে এ মসজিদের খেদমতে আছি। কিন্তু কারও মুখে শুনিনি এ মসজিদ কে তৈরি করেছেন, বা কত সালে তৈরি করা হয়েছে।

মসজিদের আরেক মুসল্লি আব্দুল মজিদ (৬৪) বলেন, ফলকে আরবিতে ৬১৬ হিজরি লেখা দেখা যায়। আর শুধু একটি নাম বোঝা যায়। নামটি হলো, মাহমুদুল্ল্যা হাসান। মসজিদের সামনে রয়েছে দুটি কবর। অনেকে বলেন কবর দুটি কোনো এক দম্পতির হবে।

শনিবার (১ মে) ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১টা। মসজিদের ভেতরে কথায় কথায় মো. ইউনুস আলী (৭০) শোনালেন এক জনশ্রুতি। ১৯৮১ সালে এলাকার আসাদুজ্জামান কবির (৬৫) নামের এক বৃদ্ধ পারিবারিক সমস্যার সমাধান পেতে ফরিদপুরের এক কামেল পীরের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তাকে বলেছিলেন, আপনাকে এরপর আর এত দূর আসতে হবে না। আপনার বাড়ির পাশে তিন গম্ভুজওয়ালা একটি মসজিদ আছে। মসজিদের সামনের দরজার সোজা পূর্বদিকে এক কামেল অলি শুয়ে আছেন। তার কবরের খেদমত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হবে।

বাড়িতে ফিরে ওই পীরের কথামতো নির্দিষ্ট স্থান খনন করে দুটি কবর দেখতে পান আসাদুজ্জামান। তখন সেখানে নিজস্ব অর্থায়নে একটি টিনের ঘরের নিচে কবর দুটি বাঁধাই করে দেন। মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, একজনের নাম মাহমুদুল্ল্যা হাসান।

তিন গম্ভুজ আর আটটি মিনার ভেতরের আয়তন ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট প্রস্থ। এতে দুই সারিতে ৫০ জন নামাজ আদায় করতে পারতেন। ইটের পুরু দুই ইঞ্চি, দৈর্ঘ্যে ১০ ইঞ্চি। মসজিদের ইট ও কবর দুটির ইটের পরিমাপ, রং ও নকশা এক হওয়ায় ধারণা করা হয়, তারাই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি পাকা কক্ষ নির্মাণ করে পুরোনো ওই মসজিদের সঙ্গে যুক্ত করে আরও ছয়টি সারি বাড়ানো হয়। এখানে এখন ১৫০ জন নামাজি নামাজ আদায় করতে পারেন।

বর্তমানে প্রাচীন মসজিদের ভূমি নকশার ওপরে সংযুক্ত করা হয়েছে একটি আধুনিক পাকা কক্ষ। মসজিদের ডান (উত্তর) পাশে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক ও উন্নতমানের ওজুখানা।

মসজিদটির দক্ষিণ পাশে প্রাচীন একটি স্থাপনা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, যা হুজারা খানা নামে পরিচিতি। এর সামনের দেয়াল চমৎকারভাবে অলঙ্কৃত ইট ও প্যানেল দিয়ে শোভিত। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ০.৯২ মি.। ভূমি থেকে কার্নিশের উচ্চতা পাঁচ দশমিক ৭৫ মিটার। চার দেয়ালের প্রতিটি কর্নার থেকে স্কুইনচ ও করবেল পদ্ধতিতে গম্ভুজ নির্মাণ করা হয়েছে। মোঘল স্থাপত্য কলার একটি অপুর্ব নিদর্শন মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের স্বর্ণ যুগের এক অপরূপ নিদর্শন হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে।