মূলধন ঘাটতিতে ১১ ব্যাংক

রোহান রাজিব : চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংক ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে; যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৩০ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে ১১ ব্যাংকের ঘাটতি বেড়েছে দুই হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কভিডের প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। কম সুদে ঋণপ্রাপ্তি ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল গত বছরেও। চলতি বছর থেকে ছাড় পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণে। ফলে গত জানুয়ারি-মার্চ সময়পর্বে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার ফলে এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণে। তাই এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে।

যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে মূলধন ঘাটতির তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছেÑরাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। আর বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে আছে। আগের তিন মাসেও এই ১১ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত মার্চ শেষে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ৯৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এ খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ৩০৩ কোটি ৩৭ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৩৬০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এছাড়া সোনালী, জনতা, বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি যথাক্রমে ২ হাজার ৩৪৪ কোটি ৬৪ লাখ, ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৮৭ লাখ, ২ হাজার ৩২৯ কোটি ৩১ লাখ ও ২ হাজার ৫৭৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ঘাটতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৩১ কোটি ২৭ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৫৯ কোটি ও পদ্মা ব্যাংকের ৩৯৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে।

আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি; সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।

জানা যায়, ঘাটতিতে থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক বছরের পর বছর বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলছে। এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির দুর্বলতা নির্দেশ করে। মূলত বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই ব্যাংকগুলোয় মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা ছাড় ও নিবিড় তদারকির পরও তাদের মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। অন্যদিকে কিস্তি পরিশোধে ছাড় আর ঋণ নবায়নের শর্ত

শিথিলের সুযোগ নিয়ে অনেকে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়েও খেলাপিমুক্ত থাকছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণ অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই এখন খেলাপি। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বছরের পর বছর বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিতে থাকা পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। এ ছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধায় পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিতে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।