সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: গত পাঁচ বছরে মূল্যবান পণ্যের ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মূল্যহীন পণ্যের চালান এসেছে একাধিকবার। চট্টগ্রাম কাস্টমসের নথি পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া যায়। আমদানির এ পুরো প্রক্রিয়াকেই অর্থ পাচার হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চীন থেকে ২০ হাজার কেজি ‘ডবল এ ফোর’ কাগজ আমদানির কথা ছিল রাজধানীর বনানীর আমদানিকারক প্রগ্রেস ইমপেক্স লিমিটেডের। কিন্তু চালানটির কায়িক পরীক্ষায় ওই কনটেইনারে বালি ও মাটি পেয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এভাবে গত কয়েক বছরের বেশকিছু চালান ধরা পড়ে। এসব চালানের আমদানিকারক হিসেবে ঢাকার সিএপি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, গাজীপুরের শ্রীপুরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান দাদা ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের এবি অ্যান্ড ডি করপোরেশন, চট্টগ্রামের ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, নারায়ণগঞ্জে এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, গাজীপুরের ইলেকট্রিক ও তামাপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান শেনঝেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সেবা এন্টারপ্রাইজ, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড ও মাহিন ট্রেডার্সের নাম পাওয়া গেছে।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়ে কয়েকটি ভুয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১২টি কনটেইনার ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কাস্টমস গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে ওই কন্টেইনারগুলো থেকে প্রায় ১৩৮ কোটি টাকা মূল্যের আমদানি নিষিদ্ধ বিপুল পরিমাণ সিগারেট, এলইডি টেলিভিশন, ফটোকপি মেশিন ও গুঁড়োদুধের সন্ধান পায়। পরে তদন্ত করে দেখা যায়, ভুয়া কাগজপত্র ও ছবি ব্যবহার করে ঋণপত্র খুলে এগুলো আমদানি করা হয়েছিল। ওই একই আমদানিকারক এর আগেও যন্ত্রপাতির নামে ৭৮টি কনটেইনার নিয়ে এসেছিল। এসব পণ্যের মূল্য এক হাজার ৪০ কোটি টাকা হলেও বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আমদানিকারক মাত্র তিন কোটি ৪৭ লাখ টাকা পরিশোধ করেছিল। এভাবে নারায়ণগঞ্জের এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ চীন থেকে ২৫ হাজার কেজি অ্যালুমিনিয়াম ও ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ক্র্যাপ আমদানির ঘোষণা দিয়ে নিয়ে আসে কনটেইনার ভর্তি ছাই। গাজীপুরের শেনঝেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড চীন থেকে কপার স্ক্র্যাপের চালান আমদানির ঘোষণা দিয়ে কনটেইনার ভর্তি পাথর এবং মাহিন ট্রেডার্স অ্যালুমিনিয়াম দন্তের কথা বলে নিয়ে আসে বড় বড় পাথরের টুকরো। আর এসব মূল্যহীন পণ্য আনার ঘটনাগুলো তদন্ত না হওয়ায় অবৈধ বাণিজ্য ও অর্থ পাচারের ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে নিয়োজিত ব্যাংক সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র এবং কয়েকজন ব্যাংক বিশ্লেষক জানান, প্রভাবশালী মহল এলসি করা পণ্যের পুরো টাকাই তুলে নিয়ে বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। এ সুবাদে বিদেশে অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ কিনতে সক্ষম হয়েছেন। বিনিয়োগের কোনো অনুমোদন না থাকলেও ইতোমধ্যে তারা বিদেশে অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ঋণপত্র খোলার সময় ওভার ইনভয়েসিং কিংবা আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিদেশে অর্থ পাচার করার অভিযোগ বা ফর্মুলা সেকেলে এবং আংশিক সত্য। এছাড়া হুন্ডি প্রক্রিয়ায় পরিমাণে খুব বেশি অর্থ পাঠানো যায় না। আর আন্ডার ইনভয়েসিং করলে টাকা বিদেশে পাচার করা হয় না। হুন্ডিতে যে টাকা পাঠানো হয় সে টাকার পণ্যও দেশে আনা হয়। তবে গার্মেন্ট বা অন্য কোনো পণ্য রফতানি করে কারসাজির মাধ্যমে তার একটি অংশ বিদেশে রেখে আসেন। এসব করে বেশি টাকা রেখে আসা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জমান শেয়ার বিজকে বলেন, মানিলন্ডারিং একটা জটিল বিষয়। তদন্ত করার জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি। তদন্তে আমদানিকারকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলে তাদের শোকজ ও তলব করা হবে। এছাড়া অভিযুক্তরা বিদেশি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি নাÑসেটাও দেখা হবে। এরপর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ, চলতি বছরের ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বলা হয়েছে, আমদানি-রফতানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েসের মাধ্যমেই প্রধানত এ অর্থ পাচার করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে সাত হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ছয় লাখ ছয় হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ বাংলাদেশের দুটি বাজেটের সমান। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।

Print Date & Time : 14 August 2025 Thursday 7:37 pm
মূল্যবান পণ্যের ঘোষণায় আসছে মূল্যহীন বস্তু
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: