কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : একটা সময় ছিল যখন কোনো উৎসব-পার্বণ কিংবা শখের বসে মানুষ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি উঠাতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন সেটি অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। মোবাইল ক্যামেরার আধিক্যয় কমে গেছে স্টুডিওর কদর। এখন মানুষ চাইলেই তাদের ইচ্ছামতো ছবি তুলতে পারেন মোবাইল ফোনের ক্যামেরার মাধ্যমে। সৌখিন কিংবা প্রয়োজনীয় যে কোনো ছবিই ঝটপট মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা যায়। ফলে স্টুডিওর দ্বারস্থ হতে হয় কমই মানুষকেই। তবে এখনও যেসব স্টুডিও করে টিকে আছে সেখানে মূলত অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ছবিই তোলা হয় বেশি।
জানা গেছে, অনেক আগেই হারিয়ে গেছে ডার্করুম, নেগেটিভ, ফিল্ম ডেভেলপ করা ও ছবি পজিটিভ করার প্রাচীন এসব পদ্ধতি। একটা সময় স্মৃতি ধরে রাখতে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলার প্রচলন ছিল মোটামুটি সব মহলেই। পরিবারের সদস্যরা, বন্ধু কিংবা সহপাঠীদের সঙ্গে তোলা সেসব ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকত নানা ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য। স্টুডিওর দেওয়ালে আঁকা ছবিতে শোভা পেত ফুল, লতা-পাতা। কিন্তু আজকের দিনে এমন স্টুডিও খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন।
এক সময় কুষ্টিয়া জেলায় অসংখ্য ছবি তোলার স্টুডিও ছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ছবি তোলার পরিমাণ বাড়লেও বর্তমানে একেবারেই কমে গেছে স্টুডিওর সংখ্যা। কুষ্টিয়া জেলা থেকে অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে স্টুডিও ব্যবসা। স্টুডিওর ছবি তোলার ব্যবসা মন্দার কারণে অনেকে এ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। বেকার হয়েছেন এই পেশার সঙ্গে জড়িত অনেক মানুষ।
কুষ্টিয়ার মিরপুরের ন্যাশনাল স্টুডিওর মালিক আনোয়ার হোসেন নিশি বলেন, ১৯৯৬ সালের দিকে স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে ব্যবসা ভালোই চলেছে। এরপর ডিজিটাল মাধ্যম আসার পর আমাদের ব্যবসায় ধস নামল। ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি তোলা শুরু হাওয়ার পর আমাদের ব্যবসা বিলুপ্ত হয়ে গেল।
তিনি আরও বলেন, সে সময় আমাদের প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল না এবং কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে স্টুডিও ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।
একই এলাকার রুপায়ন স্টুডিওর মালিক আব্দুস সালাম বলেন, ১৯৮৬ সালে প্রথম স্টুডিওতে ছবি তোলার ব্যবসা শুরু করি। ২০১০ সাল পর্যন্ত স্টুডিও ব্যবসা ভালোই চলেছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ১০০ ছবি তোলা হতো। এ ছাড়াও ফ্লিম বিক্রি, ক্যামেরা ভাড়া দেয়া হতো। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব যেমন বিয়ে, জš§দিন, সুন্নতে খৎনা, সভা সেমিনারসহ সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে ক্যামেরা ভাড়া দেয়া হতো। সে সময় ব্যবসাও হয়েছে বেশ ভালো। তবে মোবাইল ক্যামেরার প্রচলন চালু হাওয়ার পর থেকে স্টুডিওতে এসে ছবি তোলার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেল। ফলে স্টুডিও ব্যবসা অনেকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রিপা বলেন, আমি কখনই শখের বসে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি উঠায়নি। তবে আমাদের বাসায় এখনও স্টুডিওতে উঠানো কিছু ছবি রয়েছে। তবে এসব ছবির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।
স্থানীয় এবিসি কম্পিউটার অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া সেন্টারের পরিচালক মারফত আফ্রিদি বলেন, আগে মানুষ শখের বসে স্টুডিওতে এসে ছবি উঠাতেন। সে সময় স্টুডিওর ভেতরে সাজসজ্জার ব্যবস্থাও রাখা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এ ব্যবসাটি হারিয়ে গেল।
স্থানীয় রূপসা স্টুডিওর মালিক সুনিল কুমার ঘোষ বলেন, আমরা আশির দশক থেকে বংশ পরম্পরাই স্টুডিওতে ছবি তোলার ব্যবসা করে আসছি। এক এময় এ ব্যবসা আমার বাবা চালাতেন। এখন সেটি আমি ধরে রেখেছি। স্টুডিওর ব্যবসা আগে রমরমা চললেও কালের বিবর্তনে এটি এখন একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইলে ছবি তোলার প্রচলন শুরু হাওয়ার পর থেকেই মানুষ সৌখিন ছবি তুলতে স্টুডিওতে আসা ভুলে গেছে।
সাংবাদিক হুমায়ূন কবির হিমু বলেন, সবশেষ কত বছর হলো স্টুডিওতে গিয়ে শখের বসে ছবি তোলা হয়নি এটা আর স্মরণে নেই। অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন আর ডিজিটাল ক্যামেরার আগ্রাসনে অনেকটা স্টুডিও ব্যবসা নেই বললেই চলে। বর্তমানে রুগ্ণ এ শিল্প এখন পরিণত হয়েছে ফটোগ্রাফি ব্যবসায়।
কুষ্টিয়া স্টুডিও মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহমুদুল হক বাদল বলেন, ১৯৮২ সালে কুষ্টিয়া শহরেই সজল স্টুডিও গড়ে তুলেছিলাম। আমার হাত ধরে অনেকে এ কর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এ পেশায় আসার কারণে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের সরকারি বেসরকারিভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হয়নি।
স্টুডিও মালিক সমিতির এ নেতা বলেন, জেলায় এখন আর ফ্লিমের নেগেটিভ ধরে ছবি প্রিন্ট করার ব্যবস্থা নেই। যার কারণে কেউ নেগেটিভ ধরে ছবি প্রিন্ট করার জন্য এলে তাকে ফিরিয়ে দিতে হয়। এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করেন স্টুডিও মালিক সমিতির এ নেতা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক শাহ আক্তার মামুন বলেন, ছবি প্রিন্ট করার জন্য এখন আর তেমন ঝঁক্কি পোহাতে হয় না। এখন মানুষ নিকটস্থ যে কোনো কম্পিউটারের দোকান থেকেই তার প্রয়োজনীয় ছবি প্রিন্ট করে নিতে পারেন।