এ অঞ্চলের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিকাশ যেমন দ্রুত হয়েছে, বিধিবহির্ভূত কার্যক্রমে এ ধারার ব্যাংকিং সেবার ব্যবহারও তেমনি বেড়ে উঠেছে একই সঙ্গে। সদ্যসমাপ্ত বছরের নভেম্বরে সক্রিয় হিসাব সংখ্যা কমে যাওয়া থেকে প্রমাণ হয়Ñএ মাধ্যম ব্যবহার করে আইনবহির্ভূত লেনদেন বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন আগে যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তার ফল প্রাপ্তি শুরু হয়েছে। বস্তুত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন ও হিসাব পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় ব্যাংকিং চ্যানেলের রেমিট্যান্স প্রবাহেও পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা সৃষ্টির পেছনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিধিবহির্ভূত লেনদেনের যে অভিযোগ অনেকের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছিল, নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর এর প্রবাহ বৃদ্ধি থেকেও অভিযোগের সত্যতা মেলে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সক্রিয় হিসাব কমে আসার বিষয়টিকে আমরা তাই ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে চাইব। আশা করি, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু করেছেÑতা যথাযথভাবে পরিপালন করা হবে। এ লক্ষ্যে তার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তদারকিও প্রত্যাশিত।
যে কয়েকটি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানের লাইসেন্স নিয়েছে, তাদের আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশও আসে এ খাত থেকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সক্রিয় হিসাব কমে গেলে তাদের আয়ে এর প্রভাব পড়বে। তবে আশার কথা, উল্লিখিত সময়ে লেনদেন আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে প্রায় তিন শতাংশ। প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু লেনদেনের অঙ্কের ভিত্তিতে সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে চার্জ নেয়, সেহেতু বিদ্যমান ‘নিয়ন্ত্রণ’ তাদের কাছে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সার্ভিস চার্জ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছু বেশি বলেই প্রতীয়মান। এটি কমানো গেলে এ ধারার ব্যাংকিং সেবায় মানুষের আগ্রহ বাড়বে বলেই মনে হয়। তাতে লেনদেন বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি করাও কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সহজতর হবে।
বাংলাদেশে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তাতে সন্দেহ নেই। সক্রিয় হিসাব কমে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব এক্ষেত্রেও পড়বে হয়তো। এও ঠিক, একাধিক অপারেটরে এমনকি একই অপারেটরের একাধিক হিসাব পরিচালনার সুযোগ থাকায় ঠিক কতজন এ সুবিধা গ্রহণ করছেন, তা নির্ণয় করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। সংশোধিত নিয়মে তা কিছুটা সহজ হয়েছে বৈকি। এতে ক্ষেত্রবিশেষে ভোক্তাদেরও বেড়ে উঠেছে ভোগান্তি। এজন্য একই সিম ব্যবহার করে সব ব্যাংকের সঙ্গে যেন লেনদেন করা যায়, সে পদ্ধতি চালু করা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে বলেও জানা গেছে সংবাদ প্রতিবেদনে। আমরা চাইব, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ নয়Ñমানুষের ভোগান্তি লাঘবের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেও এ সুবিধা চালু করা হোক দ্রুত।
বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনও রয়েছে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তির বাইরে। এও ঠিক, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী অনেকে রয়েছেনÑযাদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। এ বিবেচনায়, বাংলাদেশে এ ধারায় ব্যাংকিং সেবা বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে এখনও। এদিকে নগদ অর্থ পরিবহন ও পরিশোধ ব্যবস্থাটি অনেকটা ঝামেলা ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনের প্রতি ঝুঁকছে মানুষ। নগদ অর্থের নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধে উৎসাহ জোগাতে দেখা যাচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এটাও মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে। এজন্য আমরা চাইব, লেনদেনকে আরও আধুনিক ও সহজতর করতে এবং প্রান্তিক মানুষকে ব্যাংকিং সেবা জোগানোর স্বার্থে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিকাশ হোক। তবে এ সেবার ব্যবহার যেন বিধিবদ্ধ খাতেই সীমিত থাকে এবং এর দ্বারা অর্থনীতি অন্য কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে রাখতে হবে সতর্ক দৃষ্টি।