ইয়াছিন আরাফাত: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের শিক্ষার পরিবেশ প্রদান করে, ব্যক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিকে উৎসাহিত করে এবং জীবনের বিভিন্ন দিকের জন্য ব্যক্তিদের প্রস্তুত করে সমাজে, দেশে এমনকি বিশ্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমনÑজ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়ন, ব্যক্তিগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি, সামাজিকীকরণ এবং নেটওয়ার্কিং, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, গবেষণা এবং উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমান সুযোগ, নাগরিক সম্পৃক্ততা, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি। সামগ্রিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিগত উন্নতি, সামাজিক অগ্রগতি এবং দেশে-বিদেশে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের অগ্রগতিতে অবদান রাখে।
কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ম্যানার শেখানোর নামে র্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার কারণে নবীন শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত উন্নতি, সামাজিক অগ্রগতি এবং দেশে-বিদেশে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের অগ্রগতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতি বছর এক বুক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় অনুরণিত হয়ে উঠে দেশের সেরা সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর এর সঙ্গে তাদের মানসিক বিকাশে প্রধান বাধা হয়ে ওঠে র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি। র্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ পরিচয়পর্ব। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে আনুষ্ঠানিক পরিচিতি প্রথা সেটাকেও র্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়। কারণ বাস্তবে আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন শেখানোর নামে তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে আছে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাখা, কান ধরে ওঠবস করানো, এক পায়ে দাঁড়িয়ে রাখা, টাইলস গণনা করতে দেয়া, নির্দিষ্ট স্থান থেকে মাটি আনতে বলা, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া, গাছে উঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, এমনকি রড দিয়ে মারা, আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি, জোরপূর্বক কাপড় খুলে নেয়া যৌন হয়রানির মতো কাজকর্ম করা হয়। আর মানসিক নির্যাতনের মধ্যে আছে কুৎসা রটানো, গালিগালাজ করা, নজরদারি এবং নিয়মিত খবরদারি করেন। যার ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমনÑশারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি, বুলিং এবং হয়রানি, ব্যক্তিগত মর্যাদার হানি, আঘাত এবং মৃত্যুর ঝুঁকি, শেখার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব, আইনি এবং নৈতিক উদ্বেগ, সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
এর ফলাফল হিসেবে অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। কাউকে কাউকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়, এমনকি অনেকে এই কুকর্ম সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাও করে। ক্যাম্পাসে আসা নবীনরা সর্বদাই র্যাগিংয়ের ভয়ে ভীত থাকে। ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত র্যাগিং যন্ত্রণার মাত্রা বেড়ে চলেছে। সিনিয়রদের কাছে র্যাগিংকে মজা হিসেবেই মনে হলেও, এর মাধ্যমে জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেখা হলে ভয়ে সালাম দিয়ে সম্মান দেখানো আর আড়ালে গিয়ে গালিগালাজ করা কখনও সম্মান হতে পারে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এটাকে আবার অনেক জ্ঞানীরা সম্মান ও শ্রদ্ধা বলে মনে করেন! আজ যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, সে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে এর চেয়ে বেশি মাত্রায় র্যাগিং করার পরিকল্পনা করবে। ফলে এ অপসংস্কৃতির উন্নতি হতেই থাকবে। আপনারাই ক্যাম্পাসে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ককে ভাই-বোনের সম্পর্ক বলেন এবং একটা পরিবার হিসেবে মনে করেন। যদি ভাই-বোনের সম্পর্কই মনে করেন, জুনিয়র পরিবারের অংশ হিসেবে মেনে নেন তাহলে তাদের র্যাগিংয়ের নামে অশ্লীল কথাবার্তা বলতে বাধ্য করেন কেন প্রপোজ করানো, জোর করে কবিতা আবৃত্তি, গান গাওয়া, নির্দিষ্ট জায়গাই গিয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলের ছবি তুলে আনতে বলা, নৃত্য করানো ইত্যাদি কি শিক্ষার অংশ? এর মাধ্যমে আপনারা আসলে কী শিক্ষা দিচ্ছেন?
ইসলামে অযথা কাউকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (আহযাব : ৫৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দুনিয়ায় যারা কাউকে নিয়ে উপহাস করে তাদের জন্য আখিরাতে জান্নাতের দরজা খোলা হবে এবং তাদের জান্নাতের দিকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা যখন কাছে এসে জান্নাতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে উদ্যত হবে তখনই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। এভাবে বারবার তাদের ডাকা হবে এবং প্রবেশ করতে গেলেই তা বন্ধ করে দেয়া হবে। একপর্যায়ে এভাবে করতে করতে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে ফিরে যাবে না। এভাবে দুনিয়ায় তার উপহাসের পরিণামে আখিরাতে তাকে নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য করি তাহলে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে রয়েছে দেশসেরা নামকরা প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পিছিয়ে নেই। স্যারকে তাড়িয়ে, বাবার সামনে মেয়েকে, ক্লাস রুমে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও র্যাগিং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যেটা সত্যিই পীড়াদায়ক।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত জ্ঞানচর্চার জায়গা। যেখানে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছেমতো বিচরণ করবে এবং জ্ঞান সঞ্চয় করবে তবে আমরা শুরুতেই কেন শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলছি? কেন তাদের স্বাভাবিক গতিপথকে রোধ করে দিচ্ছি? কেন তাদের ম্যানার শেখানোর নামে নিকৃষ্ট কাজের দিকে ধাবিত করছি? প্রকৃতপক্ষে এটা কখনও কাম্য নয়। মূলত প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় র্যাগিং নামক কুকর্ম সংঘটিত হয়। এসব প্রভাবশালী গোষ্ঠী, সংস্থা, সংগঠনকে চিহ্নিত করে এর পেছনে কারা ইন্ধন দিচ্ছে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে।
সর্বোপরি, প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী ৩০ আগস্ট থেকে অনার্স প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে। তাই আমাদের আগে থেকেই এ অপসংস্কৃতির চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে। একটি নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ তৈরি করার জন্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে এবং এই ধরনের ক্ষতিকারক অভ্যাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়