মিজানুর রহমান : দেশ মাছ চাষে বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন গ্রামে দেখা মেলে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ ও মাছের রেণু চাষ। এ খাতে লাভবান হওয়ায় অনেক কৃষক কৃষিজমিতে ধান চাষ না করে মাছ চাষ করছে। দিন দিন মাছের খামারও বাড়ছে। চাষের ধরনও পাল্টিয়েছে। দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় নতুন প্রজাতির মাছ চাষ উদ্ভাবন করে দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন। সেখান থেকে নতুন নতুন মৎস্য বিজ্ঞানী বের হচ্ছেন নবচিন্তা ও চেতনায়। তারা মৎস্য চাষকে অবিরামভাবে উদ্বুদ্ধ করে চলছেন।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জাতীয় জিডিপির এই খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ ভাগ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ খণ্ডকালীন ও পূর্ণকালীন এ পেশায় নিয়োজিত। অর্থাৎ দুই কোটির ওপরে জনগণ এ পেশায় নিয়োজিত। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকিং সুবিধার কারণে এ চার দশকে মাছের উৎপাদন ছয়গুণ বেড়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তর বলেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। তখন দেশে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন মৎস্য উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে হয়েছে ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদিত হয়েছে ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন, যা ২০০৫-০৬ সালের মোট উৎপাদনের ২৩ লাখ ২৯ হাজার টনের থেকে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সমুদ্র বিজয়ের ফলে। সমুদ্রের আয়তন মৎস্য আহরণের সহায়ক ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে।
প্রতি বছরের মতো মৎস্য চাষে উৎসাহ দেয়ার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ঘোষিত মৎস্য সপ্তাহ নানা আয়োজনে পালিত হয়। এ বছর মৎস্য সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলÑ‘নিরাপদ মাছে ভরব দেশ, গড়ব স্মার্ট বাংলাদেশ।’ মাছে-ভাতে বাঙালি। সবাই মাছ খেতে পারছে, কিন্তু সে খাওয়াটা যেন নিরাপদ হয়।
এই ১৪ বছরে সবচেয়ে বড় সাফল্য হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রজাতির মাছ বর্তমানে দেশে চাষ হচ্ছে। এগুলো স্বগর্বে ফিরে এসেছে, যেমন কই, শিং, মাগুর, টেংরা, বোয়াল, মলা, ঢেলা, শৈল, টাকি, বাইম, পাবদা, ভেটকি ও পুঁটিমাছে বাজার ভরপুর এবং কোয়ালিটি যথেষ্ট ভালো। এগুলো চাষের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ছোট মাছগুলো দেশে যেমন জনপ্রিয়, দেশের বাইরেও তেমন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় ভারতে আমরা প্রচুর পরিমাণে উদ্ধারকৃত বিলুপ্ত মাছ রপ্তানি করছি। মৎস্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, চলতি অর্থবছরে ২০২৩-২৪ সালের গত দুই মাস জুলাই-আগস্টে শুধু যশোর-বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১০ লাখ ২২ হাজার ৭৫০ ডলার মূল্যের চার লাখ ৯ হাজার কেজি সাদা মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে, যার ৯৮ ভাগই পাবদা।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাবদা, ইলিশ, ভেটকি, পারশে, টেংরা, পাঙাশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৬৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৯৬ কেজি মাছ রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি করা মাছের মূল্য ছিল দুই কোটি ৭২ লাখ ১৩ হাজার ডলার। কিন্তু রপ্তানি করা মাছের ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল পাবদা। এ মাছ চাষ করা সহজ, খরচ কম। কম সময়ে দ্রুত বিক্রয়যোগ্য করা যায়। খেতেও সুস্বাদু, দামেও ভালো। তাছাড়া বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দা থাকা সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ দশমিক ৮৮ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে দেশের আয় হয়েছে চার হাজার ৭৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য বলছে, করোনা মহামারির মধ্যে ও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ৫২টির অধিক দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া অন্যতম। তবে নেদারল্যান্ডস আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ আমদানিকারক। সাধারণত যেসব মাছ দেশের বাইরে যাচ্ছে, তার মধ্যে গলদা, বাগদা, হরিনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, স্বাদুপানির মাছ যেমন রুই কাতলা, মৃগেল, আইড়, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, কই প্রভৃতি এবং সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ভেটকি, দাতিনা, রূপচাঁদা, কাটল ফিস এবং কাঁকড়া রপ্তানি হয়ে থাকে। এছাড়া শুটকি মাছ, মাছের আঁইশ এবং চিংড়ির খোলসও রপ্তানি হয়ে থাকে। আহরিত কাঁকড়া ও কোঁচিয়াও রপ্তানি হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয়, সম্প্রসারিত সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে, যেমন অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে আছে। পাশাপাশি বিশেষ সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টশিয়ান্স ও ফিনফিস উৎপাদনে বাংলাদেশ ষথাক্রমে অষ্টম ও ১১তম স্থান দখল করে আছে। এছাড়া ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে। এছাড়া বাংলাদেশের ইলিশ ও বাগদা চিংড়ি জিআই পণ্য হিসেবে এরই মধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা আমাদের জন্য গর্বের। আশা করা যাচ্ছে, মৎস্য খাত রপ্তানি ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
ব্যাংকার, মুক্ত লেখক