Print Date & Time : 12 September 2025 Friday 4:32 pm

যত গতি তত ক্ষতি

ইলিয়াস কাঞ্চন: সারা পৃথিবীতে এখন গতি নিয়ে কথা হচ্ছে। জাতিসংঘ একটি সপ্তাহ পালন করেছে সেখানে তাদের সেøাগান ছিল Kill Speed, Not Lives মানে হচ্ছে  গতিকে মারো কিন্তু মানুষকে নয়। গতি খুবই বিপজ্জনক। আমরা গুলি বা রিভালভরের গুলির কথা বলি এ গুলিটা কিন্তু অনেক ছোটো। এটা যদি আস্তে করে কারও গায়ে ছুঁড়ে মারেন তাতে কেউ কিন্তু আহত হবে না বা মারাও যাবে না।

অথচ ওই ছোট গুলির জন্যই কিন্তু মানুষ মারা যায়। কেন মারা যায়? কারণ হলো গতির কারণে। রিভলবার থেকে যখন গুলিটি বের হয় তখন এর গতি থাকে প্রচণ্ড বেশি। এ কারণে কিন্তু এই ছোট গুলিটির কারণে মানুষ আহত হয় বা মারা যায়। এরপর দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের গতি যখন ১০০/১৫০/২০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তখন আবহাওয়া অফিস মহাবিপদ সংকেত জারি করে। ঝড় যেখানে ১৫০-২০০ কিমি বেগে যায় সেখানে মহাবিপদ সংকেত দেয়া হয়। ঝড় বৃষ্টি আর বাতাস এ দুইটির বেগের কারণে বিপদ সংকেত দেয়া হয় বৃষ্টি বা বাতাস এগুলো কিন্তু লোহার কোনো বস্তু না এরপরও এখানে এই বেগের কারণে মহাবিপদ সংকেত দেয়া হয়। এখন ভেবে দেখুন সড়কে যখন লোহার একটি বস্তু অর্থাৎ একটি গাড়ি যখন ১০০-১৫০ কিমি বেগে চলে এবং এ বেগে যদি সে গাড়ি কাউকে আঘাত করে তাহলে সেখানে কি অবস্থা দাঁড়াতে পারে? সেখানে বাঁচার কিন্তু কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এ কারণে বলা হচ্ছে গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় এ গতির কারণে।

অতিরিক্ত গতিতে যখন কোনো গাড়ি চলাচল করে তখন রাস্তায় দুই পাশে কিন্তু কোনো কিছু ঠিকমতো দেখা যায় না। খুব দ্রুত পাসের বস্তুগুলো পার হয়ে যায়। যদি কোনো মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে সে এখন দৌড় দেবে কি হাঁটবে এসব বিষয় কিন্তু ঠিকমতো লক্ষ্য করা যায় না। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সরকারিভাবে যে আইন করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে বিআরটিএ গতি নির্ধারণ করবে। কেউ যতি গতি ভাইলেশন করে তার ফাইন করা হবে। কিন্তু কোন সড়কে কত গতি, কোনো গাড়ির কত গতি থাকবে বা থাকবে না এর কোনো গাইড লাইন সেখানে নেই। আমরা এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিশেষ করে বিআরটিএ’র সঙ্গে বসেছি। সরকার সবাইকে নিয়ে বসে এ গাইড লাইন তৈরির কাজ করছে এবং এর দায়িত্ব বুয়েটের অজও (অপপরফবহঃ জবপযবৎপয ওহংঃরঃঁঃব) এর কাছে দেয়া হয়েছে। আমরাও তাদের সঙ্গে কাজ করছি। সেই সঙ্গে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচার) পক্ষ থেকে চালকদের ট্রেনিং- এর মাধ্যমে বোঝাচ্ছি গতি আমাদের জন্য, সড়কের জন্য কতটা ক্ষতি করে। আমরা যতি গতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে গাড়ি চালাতে পারি তাহলে দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে।

দেশে এত অবকাঠামো হচ্ছে, মেট্টোরেল হচ্ছে এরপরও দুর্ঘটনা রোধে কতটা উত্তরণ করতে পারছিÑপারছি না। উন্নয়ন হলেও সুদূরপ্রসারী চিন্তা না থাকার কারণে উত্তরণ করতে পারছি না। সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে জাতিসংঘ যে ৫টি পিলারের কথা বলেছে তা মেনে সুইডেন কিন্তু তাদের দুর্ঘটনার হার শূন্য এ কমিয়ে এনেছে। কোনো কোনো দেশ ৯০ শতাংশ কোনো দেশ ৮০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে দুর্ঘটনার হার। আমরা কেন কমাতে পারছি না? কারণ হলো আমাদের প্রথম দিকে যে ধারণা সেই ধারণাটাই ঠিকমতো ছিল না। আমাদের ধারণা ছিল সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের করণীয় কিছু নেই। এটা আল্লাহর হাতে আছে। মানুষের ভাগ্যে লেখা থাকে দুর্ঘটনা অনেকে বলে ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’- এমন ধারণা ছিল সবার। এজন্য অনেক সময় আমি বলি আমরা একটি দেশ পেয়েছি কিন্তু দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা সে সময় আমাদের ছিল না। যে কারণে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল। সংসদেও বলতে শুনেছি সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের কোনো হাত নেই। এটি আল্লাহর হাতে। এখানে স্পষ্ট বোঝা যায়, আমাদের দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা আসলে কখনও ছিল না। আমরা এখনও শিখছি। এই শিখতে শিখতে মাঝখান থেকে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের চিন্তাচেতনার স্পিড এখন বাড়েনি। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি না।

যেমন নবাবপুর যে রোড ছিল একটু বড়। সেটা নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছে এত বড় রোড অযথা কেন করা হয়েছে। যার কারণে দেখবেন ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় সড়কগুলো কিন্তু ছোটছোট। কারণ তখন তারা ভাবেনি আজ সড়কে ১০টা গাড়ি চলছে ১০ বছর পর কয়টা চলবে? সেই গাড়ি চলার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা আছে কি নাÑ এই যে সুদূর পরিকল্পনার দৃষ্টিটা যদি আমাদের না থাকে তাহলে আমরা উন্নয়নের সেই জায়গাটায় পৌঁছতে পারব না কখনোই।

সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা। জাতিসংঘ ঘোষিত সেইফটি সিস্টেম অ্যাপ্রোচ মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। এছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা যদি অর্জন করতে হয় তাহলে জাতিসংঘের দেয়া প্রথম ডিকেড ফেল করেছি এখন দ্বিতীয় ডিকেডটি যেন আমরা ফেল না করি সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘ কর্তৃক যে ডিকেড ঘোষণা করা হয়েছে তা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সড়ক দুর্ঘটনার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। তার মধ্যে জাতিসংঘের দেয়া ৫টি পিলার ও ৫টি রিস্ক ফ্যাক্টর চিহ্নিত করা হয়েছেÑ এ জায়গাগুলো ধরে ধরে কাজ করতে হবে। এর ভেতর প্রাইওরিটি দিতে হবে গতিকে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা তথা চিন্তার গতিকে দ্রুত বাড়াতে হবে এবং সড়কের গতিকে দ্রুত ম্যানেজমেন্টের আওতায় আনতে হবে। গতিকে ম্যানেজমেন্টের ভেতর রেখে পরিচালনা করতে হবে। এ চিন্তাগুলো এখন আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সড়কের বিভিন্ন রকম চরিত্র আছে। কোন সড়কে গাড়ি কত গতিতে চলবে সেটি যেমন নির্ধারণ করতে হবে। তেমনি যানবাহনের প্রকারভেদে গতিও নির্ধারণ করে দিতে হবে। সড়কের ব্ল্যাকস্পট বা দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোকে ট্রিটমেন্টের আওতায় এনে সংশোধন করে যানবাহন যেন নির্বিঘেœ নিরাপদে সঠিক গতিতে চলতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং এটির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারে এই বিষয়গুলো তুলে ধরে দেখিয়ে দিতে পারে কিন্তু উন্নয়নের যে গতিতে বাংলাদেশ আছে সে গতি ধরে রাখতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

কারণ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বছরে যে জিডিপি ক্ষতি হয় তার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ ৫০ হাজার কোটি টাকা যদি সড়কে ক্ষতি না হতো তাহলে দেশে আরও উন্নয়ন হতো মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হতো। সড়ক দুর্ঘটনাকে এ কারণে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত সরকার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ গতি এখন সড়ক দুর্ঘটনার ঘটার অন্যতম প্রধান কারণ। পাশাপাশি গাড়ির ফিটনেস, চালকের দক্ষতা মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহার, শিশুদের জন্য আসন ব্যবস্থাÑএসব বিষয় নিয়েও কাজ করতে হবে। এ বিষয়গুলোতে সবাইকে সচেতন হতে হবে তাহলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বাঁচবে মানুষ এগিয়ে যাবে দেশ।

পিআইডি নিবন্ধ