যমুনার ভাঙনে ঝুঁকিতে বঙ্গবন্ধু সেতু রক্ষা কাঠামো

ইসমাইল আলী: বর্ষা এলেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর পানি বেড়ে যায়। তখন খরস্রোতা নদীগুলো ভাঙতে শুরু করে। এতে প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হয় হাজার হাজার ঘরবাড়ি। একই ধরনের চিত্র দেখা যায় যমুনা নদীর ক্ষেত্রেও। নদীটির সিরাজগঞ্জ ও ভুয়াপুর পয়েন্টে প্রতি বছর বর্ষায় বড় ধরনের ভাঙন দেখা যায়। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুর রক্ষা অবকাঠামো তথা নদী শাসন কাঠামো।

ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে সম্প্রতি প্রতিবেদনটি জমা দেয় আইডব্লিউএম।

সূত্র জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতুর নদী শাসন কাজের নিরাপত্তা এবং যমুনা নদীর হাইড্রোলজিক ও মরফোলজিক্যাল অবস্থা পর্যবেক্ষণে আইডব্লিউএমকে নিয়োগ দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি কয়েক বছরের নদীর গতিবিধি, পানি প্রবাহ, ভাঙন ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রতি বছর প্রতিবেদন জমা দিয়ে আসছে। চলতি বছরের প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জমা দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, গাইড বাঁধ ও হার্ড পয়েন্টের কাছে নদী ভাঙন প্রত্যাশিত নয়। তবে পূর্বদিকের গাইড বাঁধ ও ভুয়াপুর হার্ড পয়েন্ট উভয় ক্ষেত্রে ভাঙন দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ভাঙন পুরো নদী শাসন কাঠামোর স্থায়িত্বকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। নদীটির বাম তীরে মাঝারি ও উচ্চ পানি প্রবাহে ভাঙন দেখা দেয়। এক্ষেত্রে পূর্বদিকের গাইড বাঁধ ও ভুয়াপুর হার্ড পয়েন্টের মধ্যবর্তী ৪০০ মিটার স্থান সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ভুয়াপুর হার্ড পয়েন্টের উজানে নালিনবাজার এলাকায় নদী ভাঙছে। আবার হার্ড পয়েন্টের ভাটিতেও নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।

নদীর ডান তীর ভাঙন থেকে নিরাপদ। তবে সিমলার কাছে মাঝে মাঝে ভাঙন দেখা দেয়। আবার সিরাজগঞ্জের ভাটিতেও কিছুটা ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে সার্বিক বিবেচনায় ভুয়াপুর হার্ড পয়েন্ট বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। আর সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট রয়েছে তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে।

এদিকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে যমুনার গভীরতা পরিমাপ করা হচ্ছে, যা এখনও বিদ্যমান আছে। এতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রতিরক্ষা কাঠামোর কাছাকাছি গভীর গর্ত রয়েছে। এগুলো মূলত তৈরি হয়েছে সেতুটির পূর্বদিকের গাইড বাঁধ ও ভুয়াপুর হার্ড পয়েন্টের কাছে। অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে এগুলো তৈরি হয়েছে। তবে গাইড বাঁধটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেনি। এদিকে ভুয়াপুরের উজানে নদীর তলদেশে মাটি সরে যাওয়ার প্রবণতা নেই। তবে এর ভাটিতে মাটি সরে যাওয়ার হার অনেক বেশি।

জানতে চাইলে আইডব্লিউএমের পরিচালক ও সমীক্ষা পরিচালনাকারী দলের প্রধান মীর মোস্তফা কামাল শেয়ার বিজকে বলেন, সমীক্ষার ভিত্তিতে যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তা সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় যমুনা নদীর বিষয়ে প্রকৌশলীরা যে ধারণা করে ব্যয় কমিয়ে ছিল, তা কাজে আসেনি। কারণ যমুনার তীব্র স্রোত, ঘূর্ণিপাক ও হার্ড পয়েন্টের উজানে সরুপথ দিয়ে তীব্র গতিতে পানি প্রবেশ করে। আর এক কিলোমিটার ভাটিতে এসেই নদী চওড়া হয়ে চারটি চ্যানেলে প্রবাহিত হওয়ায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এ ভাঙন ঠেকাতে যমুনার চর কেটে মূল স্রোতকে হার্ড পয়েন্টের উল্টো দিকে নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। এতে ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর ভাঙন রোধে ১৯৯৯ সালে ৩৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে খুব বেশি ফল পাওয়া যায়নি। মূল শহর রক্ষা পেলেও সিরাজগঞ্জের অসংখ্য গ্রাম প্রতি বছরই ভাঙছে। পরবর্তী সময়ে সেতু ও শহর রক্ষায় আরও বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে এক হাজার ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাপিটাল (পাইলট) ড্রেজিং অব রিভার সিস্টেম ইন বাংলাদেশ, ২৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার সদর ও কাজিপুর উপজেলায় যমুনা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট রক্ষার জন্য ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট রক্ষার জন্য ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০০৯, ২০১০ ও ২০১৩ সালে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয় সরকারকে। এছাড়া যমুনা নদী খননের জন্য গত কয়েক বছরে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের মোট ব্যয়কেও ছাড়িয়ে গেছে।

এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে গাইড বাঁধ রক্ষায়ও প্রতি বছর বোল্ডার ও পাথর ফেলে যাচ্ছে সেতু বিভাগ। গত ১৮ বছরে এ খাতে সেতু বিভাগ ব্যয় করেছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও এজন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন হয় ১৯৯৮ সালে। তবে গত ১৮ বছরে নদীভাঙন রোধ ও সেতু রক্ষায় সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, নদীর প্রকৃতি হলো, সে শাসন মানতে চায় না। এজন্য নদী শাসন করা কঠিন। আর যমুনা নদী মাত্রাতিরিক্ত শাসন করা হয়েছে। এর কুপ্রভাব সেতুটি উদ্বোধনের পর থেকেই দেখা যাচ্ছে। বাঁধ নির্মাণ, ড্রেজিংÑ কিছুতেই যমুনার ভাঙন বন্ধ করা যাচ্ছে না। নদীর মাঝে বিশাল আকারের চর পড়ছে। এছাড়া নদী কিছুটা উত্তর দিকে বাঙ্গালী নদীর দিকে সরে যাচ্ছে।

যমুনার ভাঙন রোধে গঠিত মনিটরিং সেলে ড. শামছুল হক পাঁচ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন, যমুনা নদী অতিরিক্ত মাত্রায় শাসনের ফলে কিছু বিরূপ প্রভাব দেখা যাবে, তা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। এজন্য সেতুটি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাইয়ের পরামর্শে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে তারা ঠিকমতো কাজ করেনি। এছাড়া বুয়েট বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিল, যা ঠিকমতো মানা হয়নি। ফলে নদীর হিংস্রতা ক্রমেই বাড়ছে।

জানা গেছে, বর্ষায় যমুনা সেতু নির্মাণের স্থানে নদীর প্রস্থ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কিলোমিটার, যা শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাত কিলোমিটার। এজন্য নদী শাসনের জন্য সেতুটি কমপক্ষে সাত কিলোমিটার নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়। তা না হলে সেতুটির অবস্থান কিছুটা ভাটিতে সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয় নদী শাসনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে কোনোটিই মানা হয়নি। বরং দুই প্রান্তে গাইড বাঁধ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র চার দশমিক আট কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়।

এদিকে ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের সময় নদী শাসনের পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য যমুনার অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করানো হয়। নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সে মূল্যায়ন কার্যক্রমে যমুনা নদী শাসনের বিভিন্ন দিক বেরিয়ে আসে। এ-সম্পর্কিত ‘পারফরম্যান্স রিভিউ অব যমুনা ব্রিজ রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস ১৯৯৭-২০০৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যমুনার দুই তীরে নির্মিত গাইড বাঁধ সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছে। এটা অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হলেও এখন এর কুফল দেখা যাচ্ছে। এছাড়া গাইড বাঁধের গভীরতাও কম। এতে সেতুর অবস্থান ও সংযোগ সড়ক রক্ষা হলেও তীর ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না।

এতে আরও বলা হয়, যমুনা নদীর গঠন মূলত মেয়েদের চুলের বিণুনি বেল্টের (ব্রেইড বেল্ট) মতো। আর যে স্থানে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা মূলত কর্দমাক্ত। এটা মাটির ক্ষয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নদী ভাঙন রোধে গাইড বাঁধ উভয় দিকে আরও পাঁচ থেকে ১০ কিলোমিটার বাড়ানো উচিত ছিল।

মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিআইএসের উপ-নির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় যমুনা নদী শাসনে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তা মানা হয়নি। এটি নদী ভাঙনের পাশাপাশি সেতুর অবস্থানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এজন্য সেতুর জীবনকালব্যাপী খেসারত দিতে হবে।