মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি না হওয়ায় যশোর অঞ্চলে এবার আমন ধান লাগানো দেরিতে শুরু হয়েছে। তবে জ্বালানি তেল, ইউরিয়াসহ প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার উৎপাদন খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছেন কৃষকরা। কারণ বৃষ্টিনির্ভর আমন চাষ একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে হঠাৎ জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে সেচ দিয়ে আমনের আবাদ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকদের। তেলের দাম বাড়ায় টিলার দিয়ে ধানের জমি চাষ করতে খরচ বেড়েছে, আবার ইউরিয়ার দামও বেড়েছে। সেইসঙ্গে কৃষি শ্রমিকরাও বাড়িয়েছেন মজুরি। সবমিলিয়ে দক্ষিণের ছয় জেলার ৪০ শতাংশ চাষিই আমন চাষ করবেন কি না, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। ফলে চলতি মৌসুমে যশোরসহ দক্ষিনাঞ্চলের আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার জন্য আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় চার লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৪ হেক্টর জমি। এর মধ্যে যশোর জেলায় এক লাখ ৩৮ হাজার ৯৪৭ হেক্টর, ঝিনাইদহে এক লাখ চার হাজার ৭৫০ হেক্টর, মাগুরায় ৬১ হাজার ৪৭২ হেক্টর, কুষ্টিয়ায় ৮৮ হাজার ৮৯৫ হেক্টর, চুয়াডাঙ্গায় ৩৪ হাজার ৯২০ হেক্টর ও মেহেরপুর জেলায় ২৬ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমি রয়েছে। এসব জমিতে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের ধান চাষ করার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলে ৫০ শতাংশ জমিতেও আমন ধারা চারা রোপণ করা হয়নি।
এ ছয় জেলার মধ্যে শুধু যশোর, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলায় পর্যন্ত ৬০ শতাংশ জমিতে আমনের চারা রোপণ করা হয়েছে। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় সবেমাত্র বৃষ্টি পেয়ে আমন চাষ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত অনেক চাষি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
চাষিরা জানান, আমন ধান মূলত বৃষ্টিনির্ভর। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির পানিতে সাশ্রয়ী খরচে আমন আবাদে ঝুঁকে পড়েন চাষিরা। তবে এ বছর বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় চাষিরা আমন চাষে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন। কিছু এলাকার চাষিরা ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্পের মাধ্যমে চাষ শুরু করলেও অধিকাংশ চাষিই বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সবশেষে শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টির দেখা মিললেও ডিজেল ও কেরোসিনের অস্বাভাবিক দামের কারণে বিপত্তিতে পড়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অন্যবছর এসময় পুরোদমে ধান রোপণ শুরু হলেও এবার বৃষ্টির অভাবে বেশিরভাগ জমিতেই চাষ শুরু হয়েছে দেরিতে। কাক্সিক্ষত বৃষ্টি না হওয়ায় অধিকাংশ জমিতেই সেচ দিয়ে আমন চাষ করতে হচ্ছে চাষিদের। এতে খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা।
যশোরের কায়েমখোলা গ্রামের দক্ষিণ মাঠের কৃষক মতিয়ার চলতি আমন মৌসুমে পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করবেন। তিনি জানান, ‘আর চাষ করার উপায় নেই। অবস্থা এমন যে চাষ করে আর খাওয়া লাগবে না। প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিবার সেচ দিতে চার লিটার মতো ডিজেল লাগে। আর একবার দিলে হয় না। কমপক্ষে ১০ বার সেচ দেয়া লাগে। সে হিসেবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৪০ লিটার ডিজেল লাগে সেচ দিতে। সে অনুযায়ী লিটারে ৩৪ টাকা বাড়লে আগের চেয়ে বিঘায় সেচ খরচ এক হাজার ৩৬০ টাকা বেশি লাগবে। তাতে আমার পাঁচ বিঘা জমিতে খরচ বাড়বে ছয় হাজার ৮০০ টাকা।’
মতিয়ার আরও জানান, ‘বৃষ্টির অভাবে এবার আমনেও প্রায় ইরি ধান চাষের মতো অবস্থা। শ্রাবণ মাস শেষ। বর্ষাকাল যাওয়ার পথে। অথচ যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে এ অঞ্চলের কোনো মানুষ এক কাঠা জমিও সেচ ছাড়া চাষ করতে পারেনি। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সেচ দিয়েই আমন চাষ করতে হবে।’ এছাড়া তেলের দাম বাড়ায় চাষের কাজে অন্যান্য খরচও অনেক বেড়েছে বলে তিনি জানালেন।
একই কথা বললেন মণিরামপুর উপজেলার ভাণ্ডারিয়া মোড়ের কৃষক আব্দুর রশিদ, হালমা গ্রামের কৃষক মিজানুর, আমিনুর এবং এড়ান্দা গ্রামের পাওয়ার টিলার চালক সোহেল রানা।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, জেলায় ডিজেলচালিত অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার। আর গভীর নলকূপ রয়েছে ১১৭টি। এর বাইরে পাওয়ার টিলার রয়েছে প্রায় ৯ হাজার। আমন আবাদে এসব ডিজেলচালিত সেচ পাম্প ও পাওয়ার ট্রিলার সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে। ফলে বর্তমান তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের খরচ বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, জ্বালানি তেলের প্রভাব শুধু কৃষির ওপর পড়েনি, সব ক্ষেত্রেই পড়েছে। এটি শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়। তারপরও আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে। বেশি খরচে চাষ করলেও ধানের কাক্সিক্ষত দাম পেলে কৃষক উৎপাদন খরচ মিটিয়ে লাভবান হবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. এখলাছ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে আমন আবাদ কিছুটা পেছালেও এখন বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চাষ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে যশোরাঞ্চলের ছয় জেলার আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরিই সফল হবে বলে তিনি জানান।