মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর : যশোরের তিন উপজেলায় মাছ চাষে খাদ্য হিসেবে ভাতের ব্যবহার শুরু করেছেন খামারিরা। প্রতিদিন টন টন চালের ভাত রান্না করে খেতে দেয়া হয় মাছকে। বিষয়টি অভিনব হলেও এটাকে অবৈজ্ঞানিক বলছেন মৎস্য অধিদপ্তর। মৎস্য অধিদপ্তর বিলছে, ‘বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন; কারণ ভাত হচ্ছে কমপ্লিট কার্বোহাইড্রেট। মাছের বৃদ্ধির সঙ্গে প্রোটিনের পার্সেন্টেজ সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এসব খাওয়ালে মাছের উৎপাদন কমে যাবে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, যশোরের কেশবপুর উপজেলার মধ্যকুল কালীতলা এলাকায় রাস্তার কোলঘেঁষে একটি ঘেরের ধারে বিশালাকার দুটি তাফালে (রান্না করার পাত্র) ৪০০ কেজি করে মোট ৮০০ কেজি চালের ভাত রান্না হচ্ছে মাছের জন্য। তাফাল থেকে ভাত সরাসরি নামানো হচ্ছে নৌকায়, এরপর গরম গরম সেই ভাত ছড়িয়ে দেয়া হয় ঘেরের বিভিন্ন জায়গায় মাছের খাবার হিসেবে।
মধ্যকুল কালীতলা এলাকায় যে বিলটি, তার নাম টেপোর বিল। এখানে প্রায় এক হাজার বিঘা জমিতে বছরের বেশির ভাগ সময়ই পানি থাকে। এই মাছের খাবারের জন্যে প্রতিদিন ১৬০ বস্তা চাল (প্রায় ৮ হাজার কেজি চালের ভাত) সেদ্ধ করে দেওয়া হয়।
এই হাজার বিঘা জমিতে যে ঘের, সেটিতে মাছের চাষ করেন সুলতান মোড়ল নামে একজন ব্যবসায়ী। গত ২০০৫ সাল থেকে তিনি এই ঘেরের ব্যবসা করছেন। মাছদের জন্যে ভাত, এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে প্রায় ১০ বছর ধরে। সুলতান মোড়ল জানান, এই ঘেরের পাশেই তার আরেকটি ঘের রয়েছে প্রায় ৪০০ বিঘার। সেখানেও প্রতিদিন এই অনুপাতে চাল প্রয়োজন হয়।
৫০ জন স্থায়ী কর্মচারীসহ প্রায় প্রতিদিন মোট ১০০ কর্মচারী তার এই ঘেরগুলোতে কাজ করেন। ভাদ্র মাস থেকে শুরু করে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত মাছের খাবার হিসেবে ভাত দেয়া হয়। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের আমাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সুলতান মোড়ল ১৯৯২ সালে এলাকা থেকে মাছ কিনে যশোর শহরের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করতেন তিনি।
শুধু সুলতান মোড়ল নন, আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজনও তাদের ঘেরে মাছের জন্যে ভাত রান্না করেন। তার মধ্যে মণিরামপুর হাসাডাঙ্গা মাঠপাড়া এলাকার আব্দুস সাত্তার, কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া এলাকার কামরুল বিশ্বাস, কেরামত গাজী প্রমুখ।
যশোরের কেশবপুর, মণিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঘের তৈরি করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এসব ঘেরে সাদা মাছ যেমন, রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সরপুঁটি, তেলাপিয়া, পাঙাশ, সিলভার কার্প, জাপানি রুই ইত্যাদি চাষ করা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে এসব ঘেরে মাছের খাদ্য হিসেবে রান্না করা ভাত ব্যবহার করা হয়। অবশ্য ভাতের সঙ্গে ভুসি, খইল, পালিশ, ভুট্টা, ভাসমান ও ডুবো দুই প্রকারের ফিড ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয়। খামারিরা বলছেন, ‘ভাত খাওয়ালে উৎপাদন খরচ কম লাগে। সে সঙ্গে অল্প সময়ে মাছের উৎপাদন বেশি হয়। আর মাছের খাবার হিসেবে যে চাল ব্যবহার করা হয়, তা মানুষের খাবার উপযোগী নয়।’
মধ্যকুল কালীতলার এই ঘেরের মাছের জন্যে ভাত রান্না করছিলেন তুষার গাজীসহ বেশ কয়েকজন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই দুই তাফালে প্রতিবার প্রায় ৮০০ কেজি চাল সেদ্ধ করা হয়। এই চাল মানুষের খাবারের অনুপযোগী এবং দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে। উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই চাল আনা হয়। সকাল থেকে রাত অবধি থেমে থেমে আমরা চাল সেদ্ধ করে নৌকায় নিয়ে ঘেরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিই।’
সুলতান মোড়লের এই ঘেরে ৭ থেকে ৮ বছর ধরে কাজ করেন হাবিব ফয়সাল। তিনি বলেন, ‘ঘেরে যখন মাছ ছাড়া হয় তখন তার ওজন ১০০ থেকে ২০০ গ্রামের হয়ে থাকে। আমরা তিন চার মাস ধরে তাদের ভাত খাওয়াই। একই সঙ্গে ভুট্টা, খইল, পালিশ, ভুসি, ফিড ইত্যাদিও দিই। এই খাবার সব ধরনের মাছই খায়। ঘেরে সাধারণত সাদা মাছ চাষ করা হয়। ভাত খাওয়ানোর পরে মাছের ওজন ৮০০ গ্রাম থেকে কেজির ওপরে যায়।’ সহজ উপায় আবার মাছের দামও ভালো পাওয়া যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্রে জানা যায়, জেলার তিন উপজেলায় ২৩ হাজার ৩০০ ঘের রয়েছে। এর মধ্যে মণিরামপুর উপজেলায় ১০ হাজার, অভয়নগর উপজেলায় ৯ হাজার এবং কেশবপুরে ৪ হাজার ৩০০। এসব ঘেরের মধ্যে মণিরামপুরে প্রায় ৩ হাজার, অভয়নগরে ১ হাজার এবং কেশবপুরে প্রায় ১ হাজার ৬০০ ঘেরে মাছের খাবারের জন্যে ভাত দেয়া হয়।
এই বিষয়ে যশোরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, ‘যশোরের তিন উপজেলার সাদা মাছের ঘেরগুলোর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভাত, গম, ভুট্টা সেদ্ধ করে খাওয়ানো হচ্ছে, এমন বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। এগুলো সস্তা ও সহজলভ্য বিধায় কৃষকরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। মানব স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর কিছু নেই। চাল, গম, ভুট্টার কোয়ালিটি ভালো থাকলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ‘আমরা উদ্বিগ্ন অন্য কারণে। সেটি হচ্ছে এসব খাওয়ালে মাছের উৎপাদন কমে যাবে। কেননা, মাছের বৃদ্ধির সঙ্গে প্রোটিনের পার্সেন্টেজ সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। মৎস্য চাষিরা মাছকে কমপ্লিটলি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খাওয়াচ্ছেন। এখন আমরা তাদের এই বিষয়ে মোটিভেশনের চেষ্টা করছি।’