নাঈমা আকতার:অবশেষে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণ। ডিভাইসের চতুষ্কোণ স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে তারা ফিরেছে ক্লাসরুমে, কাছে পেয়েছে প্রিয় বন্ধু-বান্ধবদের। কিন্তু গত দুদিনে খুব কম মানুষই সম্ভবত ঠিক সময়ে অফিসে বা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। ১৫ মার্চ থেকে স্কুলগুলো স্বাভাবিকভাবে খুলে যাওয়ার পরেই ঢাকা শহরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে যানজট। ট্রাফিক পুলিশ যানজট সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত গাড়ির অতিরিক্ত চাপকেই অস্বাভাবিক যানজটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের মতে, গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং স্কুলে আসা গাড়িগুলোর অধিকাংশই রাস্তার পাশে যত্রতত্র পার্কিং করে রাখায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজটের।
ঢাকা মহানগরে বাস করেন অথচ যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যানজট আমাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এতে আমাদের সময় যেমন অপচয় হয়, তেমনি বায়ুদূষণ-শব্দদূষণ বৃদ্ধি পায়, দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থাকায় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, পরিবার-আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হারিয়ে যায়। সর্বোপরি জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হয়।
যানজট নিরসনে নগর কর্তৃপক্ষ নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছেন। কখনও ফ্লাইওভার, কখনও ইউলুপ, কখনও রাস্তা প্রশস্ত করা, আরও কত কি! এসব উদ্যোগ সাময়িক সমাধান দিলেও কিছুদিন পরই যানজট ফিরে গেছে আগের অবস্থায়। কারণ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, যা যানজটের মূল কারণ এবং যানজট নিয়ন্ত্রণের সহজ সমাধান পথচারী ও সাইকেলবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে সেভাবে কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
যাতায়াত পরিকল্পনায় যান্ত্রিক যানবাহন যেভাবে প্রাধান্য পায়, সেভাবে পথচারী ও সাইক্লিস্ট বা যানজট নিরসনে হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের গুরুত্ব সেভাবে প্রাধান্য পায় না। বলা যায়, তারা উপেক্ষিতই থেকে যায়। অনেকে আবার পথচারী ও সাইক্লিস্টদের যান্ত্রিক যান চলাচলের ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করেন।
বিভিন্ন গবেষণা ও কেসস্টাডি থেকে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে হাঁটা ও সাইকেলে যাতায়াতকে প্রাধান্য দেয়া হলে যানজট হ্রাসে ভূমিকা রাখা সম্ভব। একটি ব্যক্তিগত গাড়ির দৈর্ঘ্য গড়ে ৪ মিটার, সড়কে প্রায় ১৬০ বর্গফুট জায়গা নেয় আর যাত্রী পরিবহন করে চালকসহ মাত্র ৫ জন। একটি গাড়ির জায়গায় অনেক পথচারী ও সাইক্লিস্টের স্থান সংকুলান হতে পারে। দুটি গাড়ির জায়গায় একটি বাসের স্থান সংকুলান হওয়া সম্ভব এবং একটি বাস যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০০ যাত্রী পরিবহন করে থাকে। অর্থাৎ ১ হাজার লোক বহন করতে ২৫০ গাড়ি প্রয়োজন এবং ১ হাজার মিটার রাস্তা তারা দখল করবে। সেখানে বাস একই সংখ্যক লোক বহন করতে গাড়ির থেকে অর্ধেকেরও কম (প্রায় ৩০ শতাংশ) জায়গা নেবে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় বেশি জায়গা দখল করে।
এ ছাড়া গাড়ির পার্কিংয়ের জন্য জায়গা প্রয়োজন হয় এবং দীর্ঘ সময় একটি গাড়ি পার্কিংকৃত অবস্থায় থাকে। কখনও সড়কের পাশে কখনও আবার ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং করে রাখতে দেখা যায়। এতে যানবাহন চলাচলে যেমন বাধা সৃষ্টি হয়, তেমনি পথচারী চলাচলও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। যেখানে এ শহরে শিশুদের খেলার জায়গা নেই, মানুষের আবাসস্থলের সংকট সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য যথেচ্ছ জায়গা দেয়াটা নিতান্তই বোকামি।
পথচারী ও সাইকেলবান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে যানজট হ্রাসে কার্যকরী ফলাফল পাওয়া সম্ভব। মানুষ হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের উপযোগী পরিবেশ পেলে তারা স্বল্প দূরত্বে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে আর আগ্রহী হয় না। ঢাকা শহরে প্রায় প্রতিটি পরিষেবা দুই কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যায় এবং এ দূরত্ব খুব সহজেই পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে অতিক্রম করা সম্ভব। বর্তমানে হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ পরিবেশ না থাকায় মানুষ স্বল্প দূরত্বেও গাড়ি ব্যবহার করেন। ফলে যানজট হ্রাস সম্ভব হয় না। মানুষকে যদি গাড়ির ব্যবহার থেকে নিরুৎসাহিত করা না যায়, তাহলে রাস্তা প্রশস্ত করে বা ফ্লাইওভার দিয়ে স্বল্প মেয়াদে যানজট হ্রাস পেলেও দীর্ঘমেয়াদে কোনো সফলতা পাওয়া যাবে না।
যানজট হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ এবং হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের মাধ্যমে আরও বিভিন্ন উপকারিতা পাওয়া সম্ভব। যেমনÑগাড়ির ব্যবহার হ্রাস পেলে জ্বালানি ব্যয়, কার্বন নির্গমন, বায়ু ও শব্দদূষণ হ্রাস পাবে বহুলাংশে। এতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ব্যয় হ্রাস পাবে, তেমনি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। অন্যদিকে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতের মাধ্যমে শারীরিক কার্যক্রমের চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব।
পথচারী ও সাইকেলবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ফুটপাত তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে পথচারীর উপযোগিতাকে প্রাধান্য দেয়া; সমতলে রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, সাইন, সিগন্যাল লাইট ও সাইন বোর্ড স্থাপন করা; জেব্রা ক্রসিংয়ের পূর্বে গাড়ি থামানোর জন্য আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা; পথচারীদের নির্বিঘœ ও নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের জন্য পথচারী নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করা; পথচারীদের সুবিধাদি, যেমনÑবসার ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, ছায়ার ব্যবস্থা, আলোর ব্যবস্থা প্রভৃতি নিশ্চিত করা; ফুটপাত ও সড়কে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা; যান্ত্রিক যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং অযথা হর্ন ব্যবহার বন্ধ করা, ফুটপাত তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা; সাইকেল লেন ও সাইকেল চলাচলের জন্য পৃথক সড়ক নিশ্চিত করা; সাইকেল পার্কিং ও শেয়ারিংয়ের ব্যবস্থা করা; প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াত করার মাধ্যমে কী ধরনের উপকারিতা পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ ও নগরবাসীর সচেতনতার মধ্য দিয়েই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সফলতা সম্ভব। যেহেতু বিদ্যালয়ের ট্রিপের সঙ্গে যানজটের একটা বড় সম্পর্ক পরিলক্ষিত হচ্ছে, সে কারণে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে হেঁটে যাতায়াতের পরিবেশ নিশ্চিতেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে পথচারী ও সাইকেল চলাচলের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সফলতা পাওয়া গেছে। যেমনÑনেদারল্যান্ডে ৬৭৫ কিলোমিটার সাইকেল হাইওয়ে তৈরির ফলে মানুষ গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়েছে এবং যাতায়াতের জন্য বর্তমানে সময় কম ব্যয় হয়। সেøাভেনিয়ার লিউব্লিয়ানা শহরের কেন্দ্রে পথচারী জোন তৈরির ফলে গাড়ির ব্যবহার কমে গিয়ে হেঁটে যাতায়াতের মাধ্যমে সংঘটিত ট্রিপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ আমাদের শহরেও এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছা। বারবার ব্যক্তিগত গাড়ি যানজটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও নগর কর্তৃপক্ষ থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে গাড়ির জন্য সহায়ক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে দেখা গেছে, যা পক্ষান্তরে পথচারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। যেমনÑসড়ক পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের পরিবর্তে পদচারী সেতু প্রদান করা হয়। পদচারী সেতু শিশু, নারী, বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষের পক্ষে ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পক্ষে ব্যবহার করা অসম্ভব। বিভিন্ন সড়কে রাস্তা প্রশস্ত করতে যেয়ে ফুটপাত সরু করে ফেলা হয়েছে। আগারগাঁও, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসহ বেশ কিছু সড়কে সাইকেল লেন প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কোনো রুট নেটওয়ার্ক নিশ্চিত না হওয়ায় সাইক্লিস্টরা উপকৃত হচ্ছেন না।
অতিমারি কভিডের সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে যাতায়াতের সুবিধার্থে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে পথচারী ও সাইক্লিস্টদের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বার্লিন, বোগোতা, বুদাপেস্ট, ডাবলিন, মেক্সিকো সিটি এবং নিউইয়র্ক শহরে নতুন সাইকেল লেন তৈরি করা হয়েছে। মিলানে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার ও গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করে সড়কে পথচারী ও সাইক্লিস্টদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে এবং ফুটপাতও প্রশস্ত করা হয়েছে। দুঃখজনক সত্য যে, আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। বরং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২৮ হাজার ১৯২টি ব্যক্তিগত গাড়ি এ শহরে নিবন্ধিত হয়েছে এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ গাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়বে। বর্তমানে ঢাকা শহরে ৫-৭ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। তাতেই যানজট এমন অবস্থা ধারণ করেছে, গাড়ির গতি হাঁটার গড় গতির নিচে নেমে গেছে। এখনও অনেক খানি সময় হাতে নিয়ে বেরিয়ে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি কিন্তু আর কতদিন তা সম্ভব হবে জানা নেই। কাজেই আমাদের প্রাণের ঢাকা শহরকে যদি আমরা স্থবির হয়ে যাওয়া থেকে ঠেকাতে চাই তাহলে পথচারী ও সাইক্লিস্টদের যাতায়াত পরিকল্পনায় প্রাধান্য দেয়া এবং ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।
উন্নয়নকর্মী
naima-2810@yahoo.com