যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ, শিক্ষাব্যবস্থায় মেধা ও পুঁজির দ্বন্দ্ব : খন্দকার আপন হোসাইন

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা ক্রমশ বিলাসিতায় পরিণত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ এখন টাকার থলির ওপর নির্ভরশীল। মেধা ও মননের চেয়ে অর্থই যেন নির্ধারণ করছেÑকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে আর কে পিছিয়ে পড়বে। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ার খরচ এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। হার্ভার্ডের বার্ষিক টিউশন ফি ৫৪ হাজার ডলার; যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা। গত ৩০ বছরে কলেজ ফি বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। অথচ মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ১২০ শতাংশ। নিম্নআয়ের শিক্ষার্থীদের হার্ভার্ডে ভর্তির হার মাত্র ৪.৫ শতাংশ। স্ট্যানফোর্ডে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মা-বাবা স্ট্যানফোর্ডেরই প্রাক্তন ছাত্র। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান বলেছেন, আমেরিকান শিক্ষাব্যবস্থা এখন ধনীদের জন্য একটি ক্লোজড ক্লাব। গরিব মেধাবীরা বাইরে থেকে শুধু তাকিয়ে থাকে।”পক্ষান্তরে ঢাকার শীর্ষ স্কুলগুলোর ৮০ শতাংশ শিক্ষক প্রাইভেট কোচিং করান। ব্যানবেইসের তথ্যমতে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ ‘এ+’ পাওয়া শিক্ষার্থী কোচিংনির্ভর। গ্রামীণ এলাকায় ৫০ শতাংশ ছাত্রী আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তিই হতে পারে না। বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, যেখানে বাংলা মাধ্যমের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের গড় বার্ষিক ফি ২-৫ লাখ টাকা, যা একটি গ্রামীণ পরিবারের ৫ বছরের আয়ের সমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে ৯০ শতাংশ আসন দখল করে শহুরে উচ্চবিত্ত শিক্ষার্থীরা। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ফি ২০-৩০ লাখ টাকা, যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ওইসিডির মতে, ধনী দেশগুলোতেও নিম্নবিত্ত শিশুরা উচ্চবিত্তের তুলনায় ৩ বছর পিছিয়ে। ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৫ শতাংশের নিচে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ ধুঁকছে। পৌঁছেছে সংকটের গভীরতম স্তরে। ক্যাম্পাসে নেই আগেকার সেই জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ। শ্রেণিকক্ষ ও গবেষণাগার এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। একসময় মার্কিন উচ্চশিক্ষা ছিল বিশ্বজুড়ে মেধাবীদের অত্যুৎসাহপূর্ণ গন্তব্যস্থল। আজ তা অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও মৌলিক শিক্ষার অবমূল্যায়নের শিকার। বাজেটের কশাঘাতে হারিয়ে যাচ্ছে দর্শন, ইতিহাস, নাট্যকলা। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, রাজনৈতিক দমন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে স্বপ্নের উচ্চশিক্ষা এখন আতঙ্কের নাম। ষাটের দশকের গৌরবময় উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা আজ ধ্বংসের প্রান্তে। শিক্ষাব্যবস্থার এই দশা বৈশ্বিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। পশ্চিমা সংকটের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গভীরেও। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাও ভুগছে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও পুঁজিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি কিন্তু যেন একই ট্র্যাজেডির ভিন্ন রূপ। দুই দেশের এ সমান্তরাল পতন আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। আমেরিকার বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা।

যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা সংকটের মূলে রয়েছে বহুমুখী কারণ। তার মধ্যে বাজেট সংকট অন্যতম বড় সমস্যা। সোনোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ২৪ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতির মুখে। এ সংকট মোকাবিলায় তারা ২২টি মেজর এবং ১০০-এর বেশি শিক্ষক পদ বাতিল করতে চলেছে। বাংলাদেশেও একই চিত্র দেখা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাজেট বরাদ্দ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষকদের গবেষণা বাজেট প্রায় শূন্যের কোঠায়। ল্যাবরেটরিগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব প্রকট। দুই দেশেই শিক্ষার মান ধরে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। ভর্তির হার হ্রাস একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১০ সালে আমেরিকায় কলেজে ভর্তির হার ছিল সর্বোচ্চ ১ কোটি ৮১ লাখ। ২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে সে হার এখন ক্রমাগত কমে ১ কোটি ৫৯ লাখ হয়েছে। বাংলাদেশেও উচ্চশিক্ষার প্রতি তরুণদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে বেকারত্বের উচ্চ হার। স্নাতক শেষ করেও চাকরি না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। ফলে উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দুই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিষিয়ে তুলেছে। আমেরিকায় ডিইআই (ডাইভারসিটি, ইকুইটি, ইনক্লুশন) প্রোগ্রাম বাতিলের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমেও রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট। দুই দেশেই শিক্ষার স্বাধীনতা আজ হুমকির মুখে। শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও মনন বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষকদের অবস্থানও সংকটাপন্ন। আমেরিকায় টেনিউর ট্র্যাক প্রথা প্রায় বিলুপ্তির পথে। টেনিউর ট্র‍্যাক প্রথা মূলত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়োগ, মূল্যায়ন ও স্থায়ীকরণের একটি পদ্ধতি। বাংলাদেশের শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব। দুই দেশেই শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। ফলে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে অনাগ্রহী। এই প্রবণতা শিক্ষার গুণগত মানকে আরও ক্ষুণ্ন করে চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখনও গবেষণা চলছে। কিন্তু সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে গবেষণার অবস্থা আরও শোচনীয়। গবেষণা বাজেট নগণ্য। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাপত্র প্রকাশের হার খুবই কম। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‍্যাংকিংয়ে দিন দিন নিচে নামছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ একটি অভিশাপ। আমেরিকার উচ্চশিক্ষাকে লাভজনক ব্যবসা বললে ভুল হবে না। বাংলাদেশেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৌরাত্ম্য আকাশছোঁয়া। কিন্তু গুণগত মান নিশ্চিত করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ ফি নেয়া হলেও সেবার মান বাড়ছে না। এই অবস্থা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য একটি উদ্বেগের বিষয়। আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার চাপে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও পরীক্ষার চাপ, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আমেরিকায় কারিকুলামে প্রায়ই পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু তা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। বাংলাদেশের কারিকুলামও যুগোপযোগী নয়। শিক্ষার্থীরা বাস্তবজীবনে কাজে লাগার মতো জ্ঞান অর্জন করতে পারছে না। আমেরিকায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী বা গবেষক আসছে না। এ বিচ্ছিন্নতা শিক্ষার উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অস্পষ্টতা একটি গভীর সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা এখন শুধু ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যম। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন, চিন্তাশক্তি বিকাশ এই লক্ষ্য থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রে অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশেও ডিজিটাল শিক্ষা চালু হয়েছে। কিন্তু এর সফলতা সীমিত। ইন্টারনেট সংযোগ, ডিভাইসের অভাব অনেক শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে রাখছে। আমেরিকায় শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা কমেছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকÑসবার মধ্যে শিক্ষার প্রকৃত মূল্যবোধ লোপ পাচ্ছে। আমেরিকায় শিক্ষানীতি প্রায়ই পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা সম্ভব হয় না। শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বাংলাদেশেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক পরিবর্তনের অগ্রদূত। কিন্তু এখন সেই ভূমিকা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট সৃজনশীলতাকে হত্যা করছে। বাংলাদেশেও রোটে লার্নিং প্রথা চালু আছে। এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ব্যয় সম্পর্কে জবাবদিহি করে না। বাংলাদেশে জবাবদিহিতা থাকলেও পুরোপুরি স্বচ্ছ না। এই স্বচ্ছতার অভাব দুর্নীতিকে বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষার মাধ্যমে বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। আমেরিকায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈরী মনোভাব বাড়ছে। বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানসিকতার অভাব দেখা যাচ্ছে। এই সংকীর্ণতা আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন আজ ম্লান। আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার সংকট গভীরতর হচ্ছে। বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা জরুরি। শিক্ষা সমাজের শ্রেণিবৈষম্য দূর করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা শব্দটি নিজেই বৈষম্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশÑএকই ট্র্যাজেডির ভিন্ন রূপ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ তা হলো শিক্ষাকে পুঁজির হাত থেকে মুক্ত করে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।

উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে। যুক্তরাষ্ট্রে টপ-৫০ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলো ধসে পড়বে। বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই টিকে থাকবে কি? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ। দুই দেশেই শিক্ষার বিভাজন বাড়ছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান এখন শ্রেণিযুদ্ধ। পতন যখন অনিবার্য, তখনও আশার আলো আছে। আমেরিকায় শিক্ষক ইউনিয়ন প্রতিবাদ করছে। বাংলাদেশের কিছু তরুণ গবেষক আন্তর্জাতিক মানে কাজ করছেন। দুই দেশেই শিক্ষার সংস্কার জরুরি। নইলে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে জ্ঞানের মশাল। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ ভিন্ন সংস্কৃতির দুই দেশ তবু এক সুরে ধ্বনিত হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার পতনের শোকগাথা। এ ট্র্যাজেডি থেকে উত্তরণ চাই, চাই দিকনির্দেশনামূলক নীতি, মানবিক মূল্যবোধনির্ভর পাঠক্রম এবং সর্বোপরি রাজনীতি ও পুঁজির প্রভাবমুক্ত জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। তাহলেই জ্ঞানের আলো ফের জ্বলবে। জাতি আবার গড়ে উঠবে নতুন করে।

লেখক: শিক্ষক, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল, শহিদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল।