যে আলো ছড়িয়ে গেল সবখানে

কাজী সালমা সুলতানা: ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। স্বাধীন বাংলাদেশে নেতা ফিরছেন। অধীর আগ্রহে গোটা জাতি অপেক্ষা করছে, নেতা আসছেন। সকাল থেকেই মানুষের ভিড়। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। সে ময়দানটি বর্তমানে ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ নামে পরিচিত। এই বিস্তীর্ণ পথ ও বিশাল রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত জনতার ঢল নেমেছে। নেতা আসছেন। এর ৫৫ দিন আগে এক বিভীষিকাময় দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছে এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ। যে নেতার ডাকে জীবনপণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে, সেই নেতা দেশে ফিরছেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নেতা ফিরছেন স্বাধীন জš§ভূমিতে। অবশেষে তিনি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখলেন। পা রাখলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ সংগ্রামের সফলতা এ জাতিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়ে। একজন রাজনৈতিক নেতার জীবনে এর চেয়ে বড় আর কী অর্জন হতে পারে? সেই বিশাল গৌরবের অধিকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের স্থপতি, অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন তিনি। বাবা শেখ লুৎফুর রহমান এবং মা সায়রা বেগম। মা-বাবা আদর করে তাকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু তার মা-বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার ওপর আমার মা-বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কাহাকেও বোঝাতে পারব না। তারা আমাকে খোকা বলে ডাকেন। মনে হয় আজও আমি তাদের সেই ছোট্ট খোকাটি। পারলে কোলে করেই শুয়ে থাকেন। এ বয়সেও আমি মা-বাবার গলা ধরে আদর করি।’ খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক প্রতিভার বিকাশ প্রকাশিত হয়। অন্যায়কে প্রতিবাদ ও রুখে দেওয়া তার স্বভাবে দেখা যায়। ১৯২৭ সাল; তখনও ব্রিটিশ শাসকের রাজত্ব চলছে। স্কুলছাত্র থাকাকালেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে কারাভোগ করতে হয় তাকে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু ১৯২৭ সালে হলেও কিশোর বয়সে চক্ষুরোগের কারণে লেখাপড়ায় সাময়িক বিরতি ঘটে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। সে সময় থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হন। রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেও ১৯৪৭-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

সে বছরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ জানান। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভরত অবস্থায় (১১ মার্চ ১৯৪৮) তিনি গ্রেফতার হন। সে বছরের ১৫ মার্চ মুক্তিলাভের পর ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। এতে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮-এ তাকে আটক করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ওই বছরের ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু এর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। ওই মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১৪ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান আবারও গ্রেফতার হন। দুবছর পাঁচ মাস কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫২ সালে রাজবন্দির মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি মুজিব জেলখানায় একটানা ১৭ দিন অনশন করেন। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন তিনি গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৫৬, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৬১-এর ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব ক্রমেই বাংলার জনগণের প্রিয় নেতার আসন লাভ করেন। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্রনেতাদের দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন গঠন করেন। ১৯৬২-এর শরিফ কমিশন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, লাহোরে ১৯৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ। প্রয়াত রাজনীতিবিদ জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ তার লেখায় বলেন, ‘১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব কর্তৃক ছয় দফা পেশ করা হয়। এ ছয় দফাকে কেন্দ্র করে শতাব্দীর সর্বপ্রথম বাঙালি জাতির সর্ববৃহৎ ঐক্য গড়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি, লালন ও বিজয়ের মুখোমুখি নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব শেখ মুজিবই দিয়েছিলেন। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথযাত্রায় বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবদান ছিল অতুলনীয়।’

১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা দেশে ৩২টি সভায় গণসংযাগ করেন। এ সময় তাকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় চারবার গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন।

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। ১৯৬৯ সালে গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এ মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এ গণআন্দোলনে কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন এবং সাড়ে ১১ বছর কারাভোগ করেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সে সমাবেশে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর জনগণের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন: আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধু ‘বাংলাদেশ’। অবশেষে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলা। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিবিসির এক জরিপে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাকে তিনি বিশ্বদরবারে উঁচু করে তুলে ধরেছিলেন। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তি ও মিডিয়া তাকে বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত করেছেন। ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তার ব্যক্তিত্ব ও নির্ভীকতা হিমালয়ের মতো। এভাবেই তার মাধ্যমে আমি হিমালয়কে দেখেছি।’

ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিল, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, আমরা প্রায়ই বিভিন্ন সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এটি একটি বিরল সম্মান যে, কোনো জাতির জনকের সাক্ষাৎ পাওয়া, আমি সে সাক্ষাৎ পেয়েছি; আমি শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ পেয়েছি।

সেই জাতির পিতাকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে সমাহিত করেছিল গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। তারা ভেবেছিল, এই সমাহিত করার মধ্য দিয়ে গোটা বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করা সম্ভব হয়েছে।

আজ থেকে ১০০ বছর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মনেওয়া শিশু শেখ মুজিবের আলো ছড়িয়েছে বিশ্বদরবারে। সেই শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছেন। তার আলো আজ ছড়িয়ে পড়েছে টুঙ্গিপাড়া থেকে সারা বিশ্বে।