মাসুম বিল্লাহ: বলা হয়ে থাকে, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী ব্যক্তির জন্ম হয় না।’তবে কথাটার সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করছি। এখন বলা যেতে পারে, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশের গুণীরা অন্য দেশে চলে যাবেন।’
২০০৬ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন একটা মুখরোচক বিষয় নিয়ে সবাইকে খুব আলোচনা করতে দেখতাম। আমরাও সেই আলোচনায় শামিল হতাম। বিষয়টি হলো‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা ‘মেধা পাচার’।
তখন যেসব মেধাবী এদেশ থেকে চলে যেতেন, তাদের আমরা বলতাম চরম স্বার্থপর, দেশপ্রেমহীন ও আত্মকেন্দ্রিক। বিশেষ করে তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যেত। অবশ্য এখনও সে ধারা অব্যাহত আছে বলেই মনে হয়।
এসব শিক্ষার্থীর সম্পর্কে খুবই প্রচলিত যেসব বক্তব্য ছিল তা হলো এদেশের মাটিতে জন্ম নিয়ে,এখানকার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে এবং এদেশের দরিদ্র মানুষের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া শিখে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এদেশের প্রতি কি তাদের কোনো কর্তব্যবোধ নেই? তখন আমাদেরও মনে হতো কথাগুলো তো সত্য।
কিন্তু এই মেধাবীদের জন্য যে পরিবেশ দরকার, তা এ রাষ্ট্র এখনও তৈরি করতে পারেনি। গুণী শিক্ষার্থীদের যদি কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া না যায়, তাহলে তারা তো বিদেশে পাড়ি জমাবেনই। পরবর্তীকালে বিদেশে পাড়ি জমানো বেশকিছু মেধাবীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে দেশে উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়া এবং কেউ নিজ উদ্যোগে কিছু করতে চাইলেও নানাভাবে সে উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করার মতো ঘটনা এদেশে ঘটে। তাদের এমন বক্তব্য যে অনেক খানিই সত্য, তা আবারও প্রমাণিত হলো গণস্বাস্থ্য ফার্মার তৈরি করা কিট হস্তান্তরের ঘটনার মধ্য দিয়ে।
বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যম মারফত জানা গেল, শনিবার (২৫ এপ্রিল) তারা নিজেদের উদ্ভাবিত কভিড-১৯ টেস্টিং কিট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই হস্তান্তর অনুষ্ঠানে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো কর্তা ব্যক্তি আসেননি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছে, তারা গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত ‘জিআর কভিড-১৯ ডট ব্লট’ শীর্ষক কিট নিতে আগ্রহী নন।
অবশ্য এমন অনাগ্রহের প্রমাণও মিলেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমানের বক্তব্যে। প্রথম আলো অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছেযে, এ বিষয়ে মহাপরিচালক বলেছেন, ‘আমরা কেন যাব? এটা তো অ্যাপ্রুভড (অনুমোদিত) কোনো প্রডাক্ট নয়।
তারা আবেদন করবে, তারপর নিবন্ধনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।’ অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিকতা দেখানো হবে। তাদের যুক্তি, ‘গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত পদ্ধতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী স্বীকৃত নয়।’ ভালো কথা। কিন্তু এ মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও যেসব গাইডলাইন দিয়েছে, তা কি পুরোপুরি অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে? বিভিন্ন দেশ করোনা মোকাবিলায় নিজেদের উদ্ভাবিত নানা কৌশল প্রয়োগ করে সফল হয়েছে।
তাহলে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবনের স্বীকৃতি দিয়ে তা প্রয়োগে এত বিলম্ব কেন? এমন তো নয় যে, এ পদ্ধতি কোথাও প্রয়োগ হচ্ছে না। এটির উদ্ভাবক বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীলের আগের একটি আবিষ্কার চীন গ্রহণ করেছে এবং তার সফল প্রয়োগ সেখানে হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সবকিছুই যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মডেল অনুসরণ করে করা সম্ভব হবে, তাহলে কভিড চিকিৎসায় সংস্থাটি যে অনেক বেশি হারে টেস্ট করার ওপর শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে, সেটা অনুসরণ করা হলো না কেন?
সরকারের একেক কর্তৃপক্ষ একেক ধরনের তথ্য দিয়ে মানুষকে বারংবার বিভ্রান্ত করেছে এবং এ সংকট মোকাবিলায় যে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে, তা তো স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। আচ্ছা কিটটির আবিষ্কারক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র না হয়ে যদি সরকারের ঘোর সমর্থক কোনো প্রতিষ্ঠান করত, তাহলে কি এভাবে আমলাতন্ত্র দেখানোর ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা সম্ভব হতো?
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সত্য কথা অবলীলায় বলে ফেলেন। এটাই কি তার দোষ? আজ যে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এত প্রতাপশালী ভূমিকা দেখাতে পারছে, সেই ওষুধ খাতের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে তো এই মানুষটির অনেক অবদান।
এটা কি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে? যে ওষুধ শিল্পনীতির ওপর ভর করে আজ দেশের ওষুধ খাত এত বিস্তার লাভ করেছে, যদি বলা হয় সেটি তৈরিতে ডা. জাফরুল্লাহর অবদান সবচেয়ে বেশি, তাহলে হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
ডা. জাফরুল্লাহর অপরাধ তিনি ব্যবসা করতে পারেন না। তার অপরাধ, তিনি কম দামে ওষুধ বিক্রির কথা বলেন এবং ওষুধের দাম নির্ধারণের এখতিয়ার সরকারের হাতে রাখার বিষয়ে সদা সোচ্চার থাকেন।
তার অপরাধ, তিনি প্রথাগত বেসরকারি হাসপাতালে সেবা দেওয়ার নামে রোগী ও রোগীর স্বজনদের পকেট কাটার বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে আউট অব পকেট খরচ যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি, সেটা বারংবার স্মরণ করিয়ে দেন।
তার অপরাধ,হার্টের স্টেন্টের (রিং) দাম কমানোর দাবি তোলেন। তার অপরাধ, তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেন। তার অপরাধ, তিনি একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি তোলেন। তার অপরাধ, তিনি ওষুধ খাতে মাফিয়াতন্ত্রের বিস্তারের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য তাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে দেশের এই মহা সংকট মোকাবিলায় যতটুকু উদ্যোগী হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বড় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কোনো প্রতিষ্ঠান কেন এমন উদ্যোগ নিতে পারল না? তাদের নিজেদের নতুন কিছু উদ্ভাবনের মুরোদ নেই। আবার অন্যরা যদি ভালো কিছু করতে চায়, তাহলে সে উদ্যোগে বাগড়া দিতে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দেখানো হয়।
তবে গুণীর কদর আমরা না করলেও মার্কিন মুলুক ঠিকই বুঝেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নানা অজুহাতে এটি গ্রহণে অনীহা দেখালেও মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার্স ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ঠিকই এটি গ্রহণ করেছে। এটিও কম গর্বের বিষয় নয়।
বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বসেরা, তারা আজ বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবন গ্রহণ করে একপ্রকার এটির স্বীকৃতি দিয়ে দিল। গণস্বাস্থ্য আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ‘অচ্ছুত’ প্রতিষ্ঠান হলেও মার্কিন মুলুকে ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের।
ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু তার অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আজ যে আমলাতন্ত্র কলমের শক্তির জোরে গণস্বাস্থ্যের আবিষ্কারের প্রতি সহায়ক হওয়ার পরিবর্তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, সেই আমলাতন্ত্রের কোনো সদস্য কি পারবেন ব্যক্তি উদ্যোগে নিঃস্বার্থভাবে গণস্বাস্থ্যের মতো একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে?সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নারীদের অর্থনীতির মূল স্রোতধারায় আনার ক্ষেত্রেও তার অবদান কম নয়। কেবল ভিন্ন মতাদর্শের কারণে কারও সৃষ্টিকে এভাবে অবজ্ঞা করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সবচেয়ে বড় কথা দেশ এখন ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। পারস্পরিক ‘ইগো’ দেখানোর সময় এখন নয়। করোনাভাইরাসের এই মহামারি থেকে বাঁচতে সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। সে যাত্রায় মতাদর্শের দিক দিয়ে ঘোর বিরোধী কোনো ব্যক্তি যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, সেটা সাদরে গ্রহণ করা উচিত। জাফরুল্লাহ চৌধুরী পারিবারিকভাবে বেশ বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সারাজীবন এক প্রকার শ্রমিকের মতো জীবনযাপন করেছেন।
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিসহ নানা প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কিছু ওষুধ ও পিপিইর মতো সামগ্রী অনুদান দিয়ে প্রচারে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেখানে গণস্বাস্থ্য নিভৃতে কাজ করে চলেছে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার কল্যাণে। দেশের সার্বিক কল্যাণার্থে এধরনের উদ্যোগগুলোকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় মেধাবীরা এদেশ ছেড়ে চলে যাবেন। ব্রেইন ড্রেইন ঠেকানো যাবে না।
গণমাধ্যমকর্মী
ইমেইল: md.masumbillah29@yahoo.com