যে কারণে ধানের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা দরকার

মোহাম্মদ অংকন: বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থা এখন নাজুক। অসম কৃষিজ ব্যয়, ধান ও চালের দামে অসামঞ্জস্য, তেল-সার-কীটনাশকের আকাশচুম্বী দাম, শ্রমিকস্বল্পতা, লাগামহীন মজুরি কাঠামো এবং বৈরী পরিবেশ যেন কৃষি ও কৃষককে কৃষির মূল ভাবধারা থেকে বিতাড়িত করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়নের দিকে সুনজর দিলেও কৃষকদের নিয়ে বোধহয় একদমই ভাবছে না। অথচ দেশের ৮০ ভাগ মানুষ এই কৃষি পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর ১০০ ভাগই কৃষকের উৎপাদিত চালের ভাত ও অন্যান্য শস্যদানা ভক্ষণ করে থাকেন। সবাই যেন ভাত খেয়েই ভুলে যাচ্ছেন কৃষকের উপকারের কথা। দেশে কৃষকের যে দুরবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা নিয়ে কারও কোনো ‘আ’ শব্দ শোনা যায় না কেন? দেশে কৃষিসম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কী করছে? কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও জেলা-উপজেলা কৃষি অফিসের কাজ কী তাহলে? সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধানও কিনছে না। কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন কী করে? এত শত সমস্যার পরও কৃষকরা যে প্রাণে বেঁচে আছেন, এটাই ভাগ্য বলে মেনে নিতে হচ্ছে। কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা দেখলে অজান্তেই চোখের কোণে জল চলে আসে। আমি যে কৃষকের সন্তান।
সম্প্রতি একটি দুঃসংবাদ সবারই চক্ষুগোচর হয়েছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাকা ফসলের ক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এক কৃষক। পাকা ধান পোড়ানোর ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই অভিনব প্রতিবাদের কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রতিমণ ধানের দাম থেকে প্রতিজন শ্রমিকের মজুরির দাম দ্বিগুণ। কৃষকরা ধান আবাদ করে মাঠে মারা পড়েছেন। তাই মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কতটা মনোবেদনা থেকে একজন কৃষক এমন কাজ করতে পারেন, তা বলা বাহুল্য। দেশের সব কৃষকই এখন এমন মনের দুঃখে ভুগছেন। কেননা প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকায়। প্রচলিত বাজারে এ টাকা কিছুই নয়। এক কেজি গরুর মাংস কিনতেও ৫৫০ টাকা লাগে। তেল, লবণ, পোশাক-আশাকের লাগামহীন দামের কথা নাই বা বললাম। এসবের বিপরীতে একজন শ্রমিকের দিনমজুরি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি। এতে প্রতিমণ ধানে কৃষককে লোকসান গুনতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা মানতেই কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। কৃষকের উৎপাদিত ধানের অর্ধেকই শ্রমিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। বাকিটা দিয়ে সারা বছর সংসার চালানো সম্ভব নয়।
কৃষকরা কতটা লোকসানের শিকার হচ্ছেন, এবার একটু হিসাবনিকাশ করে দেখা যাক। সাধারণত এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে ব্যয় হয়ে থাকে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। এক বিঘা জমির চারাবীজের মূল্য দুই হাজার টাকা বাদ দিলে খরচ এসে দাঁড়ায় ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা। এক বিঘা জমির গড় ফলন ২০ মণ হলে এক মণ ধানের উৎপাদন খরচ এসে দাঁড়ায় ৫০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। অথচ বাজারে ধানের মূল্য ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ প্রতিমণ ধান উৎপাদন করে কৃষকের মাত্র ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা লাভ হচ্ছে। অথচ সরকার প্রতিমণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন এক হাজার ৪০ টাকা। সরকার ঘোষিত মূল্য যদি ন্যায্যমূল্য হয়, তাহলে প্রতিমণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৩৪০ টাকা থেকে ৪৪০ টাকা। ধান-চালের বাজার মন্দা দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কম মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। কৃষকরাও অভাবের দরুন ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। সরকার ধানের যে মূল্য নির্ধারণ করেছেন, তা একসময় কার্যকর হবে বা ওই মূল্য ছাড়িয়ে এক হাজার ২০০ টাকা মণ দরেও ধান বিক্রি হবে। ততদিনে কৃষকের গোলায় ধান থাকবে না। এভাবেই লাভের সবটুকু অংশ লুটপাট করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সব ধান যখন তাদের হাতে জিম্মি হয়ে যায়, তখন বেড়ে যায় চালের দাম। ইরি মৌসুমে কৃষকরা ধানের দাম না পেয়ে হতাশ, অন্য সময় অকৃষিজ পেশার মানুষ চাল কিনতে হিমশিম খেয়ে যান।
দেখুন, সরকার ধান-চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে। তবে কৃষকদের কাছ থেকে ধান না কিনে মিল মালিক বা ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে ধান-চাল কিনে থাকে সরকার। আর এ কারণে লোকসানের শিকার হয় কৃষক, আর মুনাফা লুটে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। সরকার ধান-চালের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, তা কৃষকের জন্য লাভজনক না হলেও এটি সহনশীল মাত্রার মূল্য বলে ধরে নিয়েছেন কৃষক। তবে মূল্য ঘোষণার পর থেকে যথাযথ কার্যকর হচ্ছে কি না, তা তদারকি আবশ্যক। প্রতিবছর ইরি মৌসুমে সরকারকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অন্তত কৃষকরা বিরাটাকার ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবেন। সরকারের সদিচ্ছাই পারে কৃষকের অনাকাক্সিক্ষত লোকসান প্রতিরোধ করতে। নইলে এভাবে লোকসান গুনে ধান চাষ করতে করতে একপর্যায়ে কৃষক দেউলিয়া হয়ে যাবেন, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তখন হয়তো ধান চাষে আগ্রহ হারাবেন কৃষক। ইতোমধ্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষিজ পেশা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা তাদের পেশা বদল করতে শুরু করে দিয়েছেন। কৃষির প্রতি কৃষকের অনীহাবোধ দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ বলে মনে করি।
বর্তমান পরিস্থিতি এটা স্পষ্ট করছে যে, কৃষিতে আর কৃষকদের কোনোমতেই পোষাচ্ছে না। কৃষকরা কৃষি পেশার বিকল্প ভাবছেন। তাই অনেকে কৃষিজমি নষ্ট করে পুকুর খনন শুরু করে দিয়েছেন। কৃষি পেশার মানুষগুলো মৎস্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহবোধ বাড়াচ্ছেন। যেখানে কৃষিজমিতে শুধু ধানের চাষ হয়, সেখানে পুকুর খনন করলে মাছ চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, ফলমূল ও শাকসবজি চাষ করেও লাভবান হচ্ছেন অনেকে। কৃষিজমির ওপর গড়ে ওঠা পুকুরের আধিক্য কৃষিজ অর্থনীতিকে হ্রাস করবে। মাছ চাষের মাধ্যমে শুধু আমিষের চাহিদা পূরণ হলেও দেশজুড়ে খাদ্যশস্যের দারুণ অভাব দেখা দেবে। তখন ধান, চাল ও অন্যান্য রবিশস্য আমদানির জন্য বিদেশে হাত পাততে হবে। তখন বর্তমান পরিস্থিতির চেয়েও বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। আমরা এ কথা উপলব্ধি করতে পারছি যে, কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বলেই অকৃষিজ পেশায় যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাহলে কৃষকদের কৃষি পেশায় বহাল রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি কি না সেজন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কৃষকদের ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া ও বাস্তবায়ন করা দরকার।
বর্তমানে কৃষকরা শুধু পুকুরখননে সীমাবদ্ধ নন, অনেক কৃষক কৃষিজমিতে গড়ে তুলছেন ইটভাটা। বিঘাকে বিঘা জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে ইটভাটার কবলে। বর্তমান সভ্যতায় ইটের চাহিদা বেশি হওয়ায় লোকসান নেই এ খাতে। এছাড়া ইটের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই কৃষিজমিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে ইটভাটা। যে কৃষক আগে নিজে ধানের আবাদ করতেন, তিনি আজ চাল কিনে ভাত খাচ্ছেন। ইটভাটা পরিবেশকে যেভাবে ক্ষতি করছে, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বয়ে আনতে পারে। বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ইটভাটা বহুলাংশে দায়ী। এই পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রম কৃষক কোনোমতেই বুঝে উঠতে পারছেন না বলেই কৃষিজমিকে নষ্ট করে ইটভাটা তৈরি করছেন। একটি জমির পাশে যখন ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে, তখন পার্শ্ববর্তী জমির ফসল উৎপাদন কমছে। এক কৃষকের ভুল সিদ্ধান্তে আরেক কৃষককে ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে এমন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে কৃষিজমিকে আরও নানা ধরনের অকৃষিজ উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চলতে থাকলে দেশের কৃষি পেশা বিলুপ্ত হবে। কৃষিজ পণ্যের জন্য আমাদের আমদানিনির্ভর হতে হবে। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয়। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি ও কৃষকের যদি এমন বেহাল দশা হয়, তবে কৃষকদের আত্মহত্যা করা ছাড়া মুক্তি দেখছি না।
আমরা সার্বিক পরিস্থিতি থেকে উপলব্ধি করতে পারছি যে আমাদের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হবে। এজন্য ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ হাতে নেওয়া হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। কৃষক তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্যের জন্য অনেক আগে থেকেই সংগ্রাম করে আসছেন। কিন্তু তাদের কথার মূল্য কেউ দিচ্ছেন না। অসহায় কৃষক স্বাধীনচেতা হয়ে ছাড়ছেন কৃষি পেশাকে। ক্রমেই তারা জড়িয়ে পড়ছেন অকৃষিজ পেশায়। অনেকে হতাশায় পর্যবসিত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত হচ্ছেন। গ্রাম্য কু-রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন। কৃষিজমি বিক্রি করে দেউলিয়া হচ্ছেন। পারিবারিক ঋণগ্রস্ততা বাড়ছে। কৃষক তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ঋণ পরিশোধের তাগিদে তারা কৃষিজমিতে পুকুরখনন, ইটভাটা নির্মাণ ও কলকারখানা তৈরির কাজে সঁপে দিতে দ্বিধাবোধ করছেন না। কৃষকদের এমন ভুল পথে পা বাড়াতে দেওয়া যাবে না। কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে হবে, তবেই তারা সচেতন হবে। তাই দেশের সরকারকে কৃষি ও কৃষকবান্ধব হতে হবে। কৃষকদের প্রতি সুনজর দিতে হবে। বাংলাদেশকে উন্নয়শীল, স্বনির্ভর ও কৃষিবান্ধব করতে কৃষির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কৃষকদের সমস্যা সমাধানে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এটিই প্রত্যাশা।

ফ্রিল্যান্স লেখক

md.angkon12@gmail.com