রক্তে কেনা স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা: ১৮ মার্চ, ১৯৭১। অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস আজ। সরকারি-বেসরকারি সব ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। কর্মচারীরা অফিস-আদালতে অনুপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচিকে সফল করে তোলেন।

মুজিব-ইয়াহিয়ার পরবর্তী বৈঠকের কোনো সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার উঠে এসে মিছিলকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলো। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে, তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হেনো।’ জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও উপরে তুলে ধরো। সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’

বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য আনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি নাÑজনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে, তার সব খবরই আমি রাখি।’

এদিন রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, আগামীকাল বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়।

রাতে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। এদিন বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামে একটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিনে তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যায়।

ঢাকায় বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকেরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এদিন করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তার কোনো জবাব না পাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও তৎকালীন দৈনিক সংবাদপত্র