রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কালুপোল গন্ধর্ব রায় রাজার ভিটা ধ্বংসপ্রায়

মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: কালুপোল গন্ধর্ব রায় রাজার ভিটা সুলতানি আমলের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক বছর আগে রাজার ভিটা খনন করে দুটি স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। খননকাজ শেষ হলেও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাজার ভিটা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। একই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে এখানে গড়া জাদুঘরটি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা ঐতিহাসিক স্থানটি কয়েক মিনিটে দেখে হতাশা নিয়ে ফিরে যান। একজন নৈশপ্রহরী জাদুঘর ও রাজার ভিটা দেখাশোনা করেন। স্থানীয়দের দাবি, পর্যটনের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এই রাজভিটা। পাশাপাশি হতে পারে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও।

জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি ইউনিয়নের কালুপোল গ্রামের চিত্রা নদীর পাড়ে গন্ধর্ব রায় রাজার ভিটা রয়েছে। আর চিত্রা নদীর পাড়ে রয়েছে কালুপোলে রাজার ভিটা। খ্রিষ্টীয় ১৪-১৫ শতকের সুলতানি আমলের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন এই ভিটা দুটি। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানে রাজা ভিটা নামক প্রতœঢিবিটি শনাক্ত হয়। ২০১৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর খনন করে দুটি স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু পায়।

সুলতানি আমলের প্রত্নবস্তুর মধ্যে পাওয়া যায় ইমারতের দেওয়াল, পোড়ামাটির তৈজসপত্র হাঁড়ি, ঘট, থালা, বাটি, কলস, তৈলপ্রদীপ, প্রদীপদানি, ধূপতি, মটকা, গণনার টোকন, শিল-নোড়া, অলংকৃত ইট, চুড়ি, কড়ি প্রভৃতি। স্বল্প মূল্যমানের পাথরের গুটিকা, ফলক, বাটখারা, পাথরের পুথি ও মৃৎপত্র পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সুলতানি আমলের শহর খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট) ও মুহাম্মাদাবাদ (বারবাজার) প্রতœস্থানে প্রাপ্ত স্থাপত্যিক নিদর্শন ও প্রত্নবস্তুর সঙ্গে রাজার ভিটার সাদৃশ্য রয়েছে। সুলতানি আমলের প্রত্নবস্তুগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

রাজার ভিটার খননকাজ শেষ হলেও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ভিটা দুটি। হারিয়ে যাবে একটি ঐতিহাসিক স্থান। দুটি স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষের দেয়ালের ইটগুলো খুলে যাচ্ছে। সীমানা প্রাচীর না থাকায় এটি মানুষের অবাধ চলাচল ও গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। কালুপোল রাজার ভিটার আধুনিকায়ন ও সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে এবং পর্যটকরা ছুটে আসবে। অল্পসংখ্যাক পর্যটক রাজার ভিটা দেখতে এলেও হতাশ হয়ে ফিরে যান। সীমানা প্রাচীর, নতুন সড়ক নির্মাণ, পর্যটকদের বসার স্থান, ছাওনি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, টয়লেটসহ অন্য সব জিনিস প্রয়োজন। এগুলোর দিকে নজর দিলে দর্শনার্থী বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন স্থানীয় মানুষ। বদলে যাবে এখানকার দৃশ্যপট।

গন্ধর্ব রায় রাজা সম্পর্কে ইতিহাস গ্রন্থে তথ্য না থাকলেও স্থানীয়রা এটিকে রাজার ভিটা নামেই জানেন। চার আউলিয়ার অন্যতম হযরত মালেক উল গাউসের সঙ্গে গন্ধর্ব রায় রাজার যুদ্ধ হয়। হজরত মালেক উল গাউস প্রখ্যাত সাধক হযরত খানজাহানের (র.) সহচর ও অনুসারী ছিলেন। জানা যায়, গন্ধর্ব রায় রাজা খ্রিষ্টীয় ১৪-১৫ শতকের দিকে খানজাহান (র.)-এর সমসময়িক কোনো আঞ্চলিক রাজা বা শাসক ছিলেন।

ঝিনাইদহ জেলা থেকে আসা পর্যটক কাজি আলি আহমেদ লিকু বলেন, ইতিহাসসমৃদ্ধ স্থানটি দেখতে এসেছি পরিবার নিয়ে। এখানে পর্যটকদের জন্য সব ব্যবস্থা থাকতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলী হোসেন জানান, জাদুঘরটি উম্মুক্ত করলে আমরা ঘুরে দেখতে পারব। পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়ে উঠলে সরকার রাজস্ব পাবে।

চুয়াডাঙ্গা গড়াইটুপি গ্রামের রেজাউল করিম বলেন, রাজার ভিটার ইতিহাসটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছে। খননসহ অন্য কাজগুলো দ্রুত সময়ে শেষ করার জন্য তিনি দাবি জানান।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম রাজু বলেন, রাজার ভিটার ইতিহাস আছে। রাজাদের বসবাস ছিল। তার ইতিহাস খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন করা গেলে মানুষের মাঝে আগ্রহ তৈরি হবে। দেশ-বিদেশের মানুষ ইতিহাস যাতে সহজে জানতে পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা হবে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম ভূইয়া জানান, কালুপোল রাজার ভিটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত। এখানে রাজা ও তার দুই মেয়ের করুণ কাহিনির ইতিহাস রয়েছে। রাজার ভিটা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। এ ইতিহাসটি সবাইকে জানাতে চাই। সেজন্য এখানে আসা পর্যটকদের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। আর সে বিষয়টি লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।