ইসমাইল আলী: দেশে রপ্তানির আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দাভাবের প্রভাব পড়েছে এ খাতে। কমেছে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ও বায়ারদের ক্রয়াদেশ। দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির এ মন্দাভাবের প্রভাব পড়েছে এ খাতের কর্মসংস্থানে। কমেছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও কর্মী নিয়োগে আগ্রহী কোম্পানির সংখ্যা। পাশাপাশি কমেছে শূন্যপদের সংখ্যা।
তথ্যমতে, টানা ১৩ মাস ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর গত সেপ্টেম্বরে দেশে রপ্তানি আয় কমে। ওই মাসে ৩৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। মূলত সেপ্টেম্বরে পোশাকের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় সার্বিক রপ্তানি আয় কমে। ওই মাসে ৩১৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। গত সেপ্টেম্বরে ওভেন ও নিট উভয় ধরনের পোশাক রপ্তানি আয় হ্রাস পায়।
পরের মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় বাড়লেও ক্রয়াদেশ কমেছে টানা তিন মাস (আগস্ট-অক্টোবর)। এর মধ্যে শুধু অক্টোবরেই রপ্তানি আদেশ কমেছে ২০২১ সালের একই মাসের চেয়ে ২০ শতাংশ। এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তা ছিল ৪৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।
ইপিবির তথ্যমতে, গত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৪ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। আর জুলাই-ডিসেম্বরে ইইউতে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে প্রবৃদ্ধির হার ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের ছয় মাসে তা ছিল ২৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
যদিও বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির বিধিনিষেধ শিথিল হতে শুরুর পর থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে বাংলাদেশ গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যে প্রভাব পড়েছে, তা এখনও কাটানো যায়নি। অথচ গত অর্থবছর বাংলাদেশ রেকর্ড ৪২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি করে, যাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ শতাংশের বেশি।
তৈরি পোশাক খাতে মন্দা নামার প্রভাব পড়তে শুরু করে এ খাতে কর্মসংস্থানে। বিভিন্ন গার্মেন্ট তাদের কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দেয়। কমে যায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও। বিশেষ করে ডিসেম্বরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল। দেশের অন্যতম অনলাইন চাকরির বিজ্ঞাপনদাতা সাইট বিডিজবস ডটকমের পোশাক খাতের বার্ষিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্যমতে, গত চার মাসে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) বিডিজবস সাইটে তৈরি পোশাক খাতের এক হাজার ২৫৫টি কোম্পানি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এসব বিজ্ঞপ্তিতে মোট চাকরির পদসংখ্যা ছিল তিন হাজার ৪৪৮টি। আর শূন্যপদ ছিল পাঁচ হাজার ৩৯৩টি। যদিও ২০২১ সালের শেষ চার মাসে বিডিজবস সাইটে তৈরি পোশাক খাতের এক হাজার ৩৫৮টি কোম্পানি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। এসব বিজ্ঞপ্তিতে মোট চাকরির পদসংখ্যা ছিল চার হাজার ২০০টি। আর শূন্যপদ ছিল ছয় হাজার ৮১০টি। অর্থাৎ গত বছর চার মাসে চাকরির সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ ও শূন্যপদ কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। আর এ সময় কর্মী খোঁজা কোম্পানির সংখ্যা কমেছে প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ।
জানতে চাইলে দেশে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এখন বিশ্বব্যাপী রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে এবং সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বায়ারদের কেনার সক্ষমতা কমে গেছে এবং চাহিদাও কমেছে। ফলে গত কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে অর্ডার কমেছে, যে কারণে আমাদের দেশের কারখানাগুলোয় সক্ষমতার কম উৎপাদন হয়েছে এবং কর্মী কাজ করছে। গত কয়েক মাস রপ্তানি ভালো করেছে, কারণ অর্ডারগুলো আগে নেয়া ছিল। কিন্তু আগামী কয়েক মাস আমাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই কোম্পানিগুলো নতুন নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে।’
বিডিজবসের তথ্য পর্যালোচনা করে থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৩৭টি কোম্পানি ৯৩১টি বিজ্ঞপ্তিতে এক হাজার ৩১৪টি পদে কর্মী নিয়োগের আগ্রহ দেখায়। অথচ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৪০টি কোম্পানি এক হাজার ১২৫টি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা দুই হাজার দুটি পদে কর্মী নিয়োগের আগ্রহ দেখায়। পরের মাসে ২০২১ সালের ৩৩৫টি কোম্পানি এক হাজার ৩৬টি বিজ্ঞপ্তিতে এক হাজার ৫৫১টি পদে নিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছিল। ২০২২ সালের অক্টোবরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩০টি কোম্পানির ৯২৫টি বিজ্ঞপ্তি এবং এক হাজার ৩৬৪টি শূন্যপদ।
একইভাবে গত নভেম্বরে ৩০৮টি কোম্পানি এক হাজার ৫২৫ শূন্যপদের জন্য ৮৪৬টি বিজ্ঞপ্তি দেয়। আগের বছর একই সময়ে তা ছিল ৩৫১টি কোম্পানির এক হাজার ১২টি বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে এক হাজার ৫৬০টি শূন্যপদ। আর গত বছরের শেষ মাসে ২৮০টি কোম্পানিতে ৭৪৬টি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এক হাজার ১৯০টি শূন্যপদ পূরণে আগ্রহ দেখায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর তা ছিল ৩৩২টি কোম্পানির এক হাজার ২৭টি বিজ্ঞপ্তি এবং এক হাজার ৬৯৭টি শূন্য পদ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কায় চলতি বছর তৈরি পোশাকসহ সার্বিক রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে নতুন করে কর্মী নিয়োগ নিয়ে ভাবছে না কোম্পানিগুলো। তবে রপ্তানি আদেশ বাড়লে এ চিত্র ইতিবাচক রূপ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে কম হলেও আমরা খারাপ অবস্থাতে বেশকিছু নিয়োগ দিয়েছি এবং কর্মসংস্থান তৈরি করেছি। তবে এ বছর খারাপ অবস্থাতে অর্ডার বাড়ানোর জন্য নতুন বাজার ও নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন করে নিয়োগ না দিলেও আগে থেকে যারা কাজ করে যাচ্ছে, তাদের ধরে রাখার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’