মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান: কভিড অতিমারির কারণে দেশে দেশে যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু। বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিতে এর যে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সন্তোষজনক রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়া। কারণ ছিল আশানুরূপ রেমিট্যান্স না আসা, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া এবং ডলারের চাহিদা হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এই ডলার সংকট হ্রাস পেলেও তা সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত না হওয়ায় সরকার প্রচলিত পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) বা ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক পণ্য তদ্রƒপ অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্য।
কোনো দেশের জিআই পণ্য দেশটির সাদৃশ্যহীন গুণাবলি, যথা জলবায়ু, মাটি, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা, উৎপাদনের বিশেষ প্রক্রিয়া ও দক্ষতা, এমনকি বংশ পরম্পরায় পেশাগত ঐতিহ্যের সমাহার, যা স্থানীয় অধিবাসী ও পণ্যটির মধ্যে এক গভীর যোগসূত্র স্থাপন করে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে জিআই পণ্য মেধাসম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এটি কোনো দেশের মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়ার অংশ। এভাবে ট্রেড মার্কসের মতো জিআইও একটি ব্র্যান্ড, যা কোনো ক্রেতার সুনির্দিষ্ট চাহিদা বা স্বাদ পূরণ করার ক্ষেত্রে একটি উপযোগী পণ্য হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে এমনকি স্থানীয় বাজারেও ইলিশ মাছ বেচাকেনা হয়। তবে পদ্মার ইলিশের যে স্বাদ তা বাংলাদেশের ইলিশ। বিশেষ এই প্রজাতির মাছের উৎপাদন পদ্মা অববাহিকার মিঠা পানিতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইলিশ নামকরণ হলেই শুধু ভোক্তারা এই সুস্বাদু মাছ খেতে সমর্থ হন। এশীয় দেশগুলোর জন্য বাণিজ্যভিত্তিক এই বাস্তবতা সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর ছিল না। তবে সাম্প্রতিককালে এই ভৌগোলিক নির্দেশনা পণ্যের সুরক্ষায় স্থানীয়ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এখন পর্যন্ত ভারতে কৃষি, খাদ্য, অলংকার, আসবাবপত্র শাখার দুই শতাধিক পণ্য নিবন্ধিত হয়েছে জিআই পণ্য হিসেবে, যেখানে বাংলাদশে এই সংখ্যা মাত্র ১১টি।
তবে একটি গবেষণায় দেখা যায় খাদ্যসামগ্রী, হস্তশিল্প ও তাঁতবস্ত্র-সম্পর্কিত দেশের প্রায় ৭৩টি পণ্যই নিজস্বতা থাকায় তা নিবন্ধনের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে নিবন্ধিত জিআই পণ্য হচ্ছে জামদানি, ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারি ভোগ চাল, কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি এবং রাজশাহীর সিল্ক, মসলিন ও ফজলি আম। ২০১৬ সালে জামদানি শাড়ি প্রথম এই স্বীকৃতি পায়। সবশেষ ২০২২ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাগদা চিংড়ি ও ফজলি আম।
মেধাসম্পদের আওতাভুক্ত হওয়ায় জিআই পণ্য কতিপয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং নির্দেশনার আওতায় চিহ্নিত হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ট্রিপস ও উইপোভুক্ত কতিপয় চুক্তি। এভাবে জিআই পণ্যের ক্ষেত্রে যে কোনো জটিলতা বা মালিকানা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বাসমতী চালের মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের স্বত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব-বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অরগানাইজেশনের উইপো (ডওচঙ)। উইপোর নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই মেধাস্বত্ব স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এ পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। কিন্তু বাংলাদেশি পণ্যগুলোর এখনও কোনো বড় সাফল্য বা এসব পণ্যের রপ্তানি বাড়েনি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এসব পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে চেষ্টা চলছে। এখনও অর্থনীতিতে বড় অবদান না রাখলেও এগুলো নিয়ে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করনে অর্থনীতিবিদরা। স্বীকৃতি পাওয়ার পর এসব পণ্য উৎপাদনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোরও পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি এসব পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের পরিচয় তুলে ধরবে বলেও মনে করেন তারা।
এটি স্বীকার্য, বাংলাদেশে জিআই অ্যাক্ট ও জিআই বিধিমালা জারির পর বহু পুরোনো ও নিজস্ব পণ্যগুলো সুরক্ষার সুযোগ অবারিত হয়েছে। নিজ দেশের পাশাপাশি অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার শর্তে সে দেশেও রপ্তানির সুযোগ ঘটে। তবে একটি দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ‘জিআই অ্যাক্ট ২০১৩’ জারি করা একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। কেননা শুধু জিআই অ্যাক্ট জারির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী পণ্যটির সুরক্ষা সম্ভব নয়, এর জন্য সম্ভাব্য সব পণ্য চিহ্নিত করে জিআইভুক্ত করতে হবে। এজন্য বহুল প্রচার ও গবেষণার মাধ্যমে জিআই নিবন্ধনের গুরুত্ব প্রদানে সংশ্লিষ্ট মহলকে সচেতন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জিআই পণ্যের কার্যকর বিপণনে একক বা যৌথ উৎপাদনের উভয় ক্ষেত্রেই মার্কেট শেয়ারের জন্য বিপণন পরিকল্পনা অপরিহার্য। জিআই পদ্ধতির অনুসরণে আন্তর্জাতিক বাজার বাস্তবতা, সমন্বয় ও ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে যথার্থ বিপণন পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তার মধ্যে পণ্য পৃথক্করণ, ভোক্তা আচরণ, ভ্যালু চেইন ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। নতুন যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই এসব বাজার প্রভাবকারী উপাদানগুলোর পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক।
তৃতীয়ত, জিআই পণ্য উৎপাদকরা মধ্যস্বত্বভোগীদের নেতিবাচক আচরণের শিকার। সরবরাহ চেইনের এই চ্যালেঞ্জ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মর্যাদা রক্ষা ও উৎপাদক শ্রেণিকে উৎসাহিত করার জন্য সমগ্র জিআই পদ্ধতির পক্ষে কার্যকর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা জরুরি। এভাবে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের জিআই পণ্য বিপণনের জন্য এ খাতের সার্বিক পর্যালোচনাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই।
যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে, সে কারণে রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে সরকারের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এসব পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।
পিআইডি নিবন্ধ