রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান: অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের চতুর্থ ইউনিট বিশ্বের এক নম্বর বা শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি লাভ করেছে। গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) মান সনদে পরিবেশবান্ধব কারখানার এ স্বীকৃতি মিলেছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইউএসজিবিসি এ সনদ ইস্যু করেছে এবং এটি পরিবেশবান্ধব কারখানার বিভিন্ন মানদণ্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০৪ পেয়েছে। আরও গৌরবের খবর হচ্ছে, ইউএসজিবিসির সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার আটটিই বাংলাদেশের এবং বাকি দুটির একটি ইন্দোনেশিয়ার ও একটি শ্রীলঙ্কার। ২০১৮ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্বের সেরা পরিবেশবান্ধব কারখানাটি ছিল। তখন কারখানাটি ১১০ নম্বরের মধ্যে ১০১ পেয়েছিল। তাছাড়া এ তালিকায় বিশ্বের পরিবেশবান্ধব শীর্ষ ১০০ কারখানার মধ্যে ৫২টিই বাংলাদেশের এবং এ তালিকায় চীনের ১০টি কারখানা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এরপর পাকিস্তানের ৯টি কারখানা, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের আছে ছয়টি করে ১২টি এবং ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের আছে চারটি করে আটটি কারখানা।

বর্তমানে বিশ্বে সবুজ কারখানা বা শিল্পায়নের গুরুত্ব, জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা প্রশংসনীয় হারে বাড়ছে। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮৩টি সনদপ্রাপ্ত সবুজ কারখানা রয়েছে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ এবং আরও ৫০০টি কারখানা পাইপলাইনে আছে, যেগুলো শিগগিরই সনদপ্রাপ্ত হবে। বাংলাদেশে লিড সনদ পাওয়া ১৮৩ পোশাক ও বস্ত্র কারখানার মধ্যে ৬০টি লিড প্লাটিনাম, ১০৯টি গোল্ড, ১০টি সিলভার ও চারটি সার্টিফাইড সনদ পেয়েছে। গত বছর তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের মোট ২৭টি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব কারখানার

সনদ পেয়েছে।

সাধারণত সবুজ কারখানাগুলো সংশ্লিষ্ট সব রকম আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে তৈরি করা হয়। এ ধরনের কারখানা স্থাপনের সময় জ্বালানি ও পানি সাশ্রয়, বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সৌরবিদ্যুৎ উৎস, সেন্সরসহ লাইট ও সাইকেল স্ট্যান্ড রাখা উল্লেখযোগ্য। পানি সাশ্রয়ের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ওয়াটার রিসাইক্লিং ব্যবস্থা, পানির অপচয় কমানোর জন্য সেন্সরসহ কল ও অত্যাধুনিক স্যানিটারি ফিটিংসের ব্যবহার অপরিহার্য। শুধু তা-ই নয়, একটি সবুজ কারখানায় অভ্যন্তরীণ বায়ুর মানমাত্রা এএসএইচআরএই মানদণ্ড অনুযায়ী বজায় রাখতে হয়। এছাড়া কারখানার অভ্যন্তরে সহনীয় মাত্রায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা একজন শ্রমিকের সুস্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

একটি সবুজ কারখানার প্রাথমিক ভিত্তি হলো দক্ষ ও টেকসই উৎপাদন, যা পরিবেশ ও ব্যবসায়িক স্বার্থকে ভারসাম্যপূর্ণ করে। সবুজ কারখানা স্থাপন করার সময় ইউএসজিবিসির সব ধরনের নীতিমালাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। একটি কারখানাকে লিড সার্টিফায়িড হওয়ার জন্য ইউএসজিবিসির নির্দেশিত ছয়টি নির্দিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম মান অর্জনের মাধ্যমে ইউএসজিবিসি থেকে সনদ গ্রহণ করতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে টেকসই স্থান, দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুতের ব্যবহার, উন্নত কর্মপরিবেশ প্রভৃতি। কোনো শিল্প বা কারখানা যদি এ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়, তখন প্রদত্ত নম্বরের ভিত্তিতে কারখানাটি লিড সনদ অর্জন করে। যেমন যখন কোনো কারখানার বিল্ডিং ৮০ বা তদূর্ধ্ব পয়েন্ট পায়, তখন সেটি ইউজিতে লিড প্লাটিনাম বিল্ডিং হিসেবে সার্টিফায়িড করা হয় এবং একইভাবে ৭০ বা তদূর্ধ্বকে গোল্ড ও ৬০ বা তদূর্ধ্বকে সিলভার হিসেবে সার্টিফায়িড করা হয়। টেকসই ডিজাইন হচ্ছে সবুজ কারখানার মূলকথা। এ প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদকে সাশ্রয়ী উপায়ে ব্যবহার করে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়। বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে সর্বমোট ১১০ নম্বরের মানদণ্ডে স্থাপনাটিকে মূল্যায়ন করা হয়।

বাস্তবতা হচ্ছে একটি সবুজ কারখানা স্থাপন কিংবা সংস্কার করা অনেকাংশেই ব্যয়বহুল। এটি তৈরি করতে উন্নত প্রযুক্তির মালামাল ব্যবহার করতে হয়। যেমন ভিওসি ফ্রি পয়েন্ট, আরইউজি সার্টিফায়িড, এফএসসি সার্টিফায়িড, এএসএইচআরএই, এনার্জি স্টারসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করতে হয়। ফলে একটি সবুজ কারখানা স্থাপন করতে সাধারণ কারখানার তুলনায় অন্তত ২০-৩০ শতাংশ ব্যয় বেশি হয়। কিন্তু যেহেতু সবুজ কারখানা স্থাপন একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ, তাই এক্ষেত্রে বিনিয়োগ সবদিক বিবেচনায় লাভজনক এবং আন্তর্জাতিক সুনাম ও সুখ্যাতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের সবুজ অর্থায়নের নীতিমালা আরও সহজ করা উচিত। তবে ইউএসজিবিসির সবুজ কারখানার যে নীতিমালা, সেখানে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয় এবং এর মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য কাজ করার পরিবেশ আরও মনোরম হয়। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, উন্নত যন্ত্রপাতি ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কারণে সবুজ অবকাঠামোতে শ্রমিকরা কাজ করতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

আমাদের দেশে মূলত তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল করতে থাকে। এমনকি দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো নন-কমপ্লায়েন্সÑএমন অভিযোগ এনে সেগুলো বন্ধের জন্যও চাপ দেয়। ইউরোপ ও আমেরিকান ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে উদ্যোক্তাদের মধ্যে রীতিমতো ভীতি সৃষ্টি করে এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে চরম অস্বস্তি বিরাজ করছিল। পরবর্তী সময়ে শিল্প মালিকদের গঠনমূলক নানা উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ক্রমেই সেই অনিশ্চিত অবস্থা কেটে গিয়ে দারুণ চমৎকার এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী সবুজ শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকছে।

সবুজ শিল্পায়ন ধারণার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পরিবেশের সুরক্ষা। পরিবেশবান্ধব, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসসাশ্রয়ী এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হলেও সবুজ শিল্পায়ন ধারণার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আমাদের তৈরি পোশাক খাতকে। অনেক বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের তৈরি পোশাক খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। তৈরি পোশাক সামগ্রীর ক্রেতা, দেশ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গোষ্ঠী এখন তৈরি পোশাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছে, যেসব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই শুধু তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এজন্য এখন তৈরি পোশাকশিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সবুজ শিল্পায়ন ধারণার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনেও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্বসহ দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্টসম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, তথাপি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সোলার হোম সিস্টেম রয়েছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিজিএমইএ এরই মধ্যে ইএনএফসিসির উদ্যোগে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি চার্টার ফর ক্লাইমেট অ্যাকশনে স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতির আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সমান্তরালে অগ্রগামী আর টেকসই শিল্পায়নের জন্য পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ও কর্মপরিবেশের বিকল্প নেই। শিল্প যুগের আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা যা ছিল, তা থেকে এখন অনেক বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা আরও ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে বলে আইপিসিসি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) রিপোর্টে বলা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে সবাই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অবগত ও সচেতন। ক্রেতারা বিশেষ করে তরুণ ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের সময় ওই পণ্যের পরিবেশগত মান, যেমন কার্বন ফুটপ্রিন্ট, ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট, ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট প্রভৃতি বিষয়ে অবগত হতে চান। সবাই এখন পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ক্রয় ও ব্যবহারে আগ্রহী। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে সবুজ শিল্পায়নের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু যে ক্রেতাগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করা যায় তা-ই নয়, ব্র্যান্ডিং অ্যান্ড ইমেজ বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও পরিবেশবান্ধব শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি এর মাধ্যমে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করার নজিরও তৈরি হচ্ছে। এ কারণে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য শুধু তৈরি পোশাকশিল্পেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও টেকসই সবুজ শিল্পায়নের গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com