রপ্তানি সক্ষমতা অর্জনে সব শিল্পকে সমান সুযোগ দিতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও সহায়ক নীতি সহায়তা, তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানিমুখী সব শিল্পে সমান সুবিধা নিশ্চিতকরণ, মানব সম্পদের উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় নীতিমালার দ্রুত সংস্কার ও যথাযথ বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক নেগোসিয়েশনে দক্ষতা বাড়ানো, গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ ও বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়গুলোই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আয়োজনে গতকাল ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণে চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে বক্তারা এ কথা বলেন। সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান।

সংলাপে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সাল-পরবর্তী সময়ে অনেক রপ্তানি বাণিজ্য ও স্বল্প ব্যয়ে ঋণ সুবিধাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের শুল্ক-অশুল্ক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের ১ হাজার ৭৫০টি রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৮১ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের অন্তর্ভুক্ত। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সময়ে দেশের রপ্তানি শিল্প পোশাক খাতসহ অন্যান্য মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প যেমন পাট, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা, ফার্মাসিউটিক্যাল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইসিটিসহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের রপ্তানির বাজার ধরে রাখতে ও বাজারে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে আমাদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বলেন, আমাদের রপ্তানি পণ্যের বাজার মূলত ইউরোপ ও আমেরিকাভিত্তিক, তবে সময় এসেছে বর্তমান বাজারের বাইরে বিশেষ করে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাজার সম্প্রসারণে মনোযোগী হওয়ার এবং পণ্যের পাশাপাশি সেবা রপ্তানির বিষয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করাকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন, সেই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতের ন্যায় অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউসসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর, সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালের মহাব্যবস্থাপক নাইমুল হুদা, এসিআই মবিলিটি, প্লাস্টিক অ্যান্ড এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এফএইচ আনসারী, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড অ্যাক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইআইওএ) সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক অংশ নেন।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ বিভিন্ন সূচকে আমাদের ধারাবাহিক উন্নয়নের একটি স্বীকৃতি। তবে এর ফলে অর্থনীতির কোথায়, কী ধরনের প্রভাব পড়বে তার জন্য আমাদের হোমওয়ার্ক করতে হবে। মোস্তাফিজ বলেন, আমাদের দেশীয় আইন ও নীতিমালাগুলোকে ডব্লিউটিও সুপারিশের আলোকে সংশোধন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

তিনি উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন হয়ে গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, তা যেমন সত্য, সেই সঙ্গে শিল্প-কারখানাগুলোয় কাজ করার জন্য দেশীয় মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন করা না হলে বিদেশি নাগরিকরা এখানে আসবে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজ দেশে নিয়ে যাবে। তাই আমাদের নিজস্ব মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন খুবই জরুরি। পাশাপাশি তিনি সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএ স্মারক স্বাক্ষরে আরও গতি আনায়নের ওপর জোরারোপ করেন।

সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানির যেসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি থেকে দেয়া হয়, সেখানে বেশকিছু গরমিল রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি এ খাতে বিদেশ থেকে টাকা আনতে নীতিগত প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, করোনাকালে সারা পৃথিবীতে সাস (সফটওয়্যারভিত্তিক সেবা) মডেল বেশ জনপ্রিয় হয়েছে এবং বাংলাদেশ হতে সফটওয়্যারভিত্তিক সেবা আমদানির বিষয়টি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এ জন্য নীতি সহায়তা খুবই জরুরি।

সাইফুল ইসলাম বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়ন হলে আমাদের নেগোসিয়েশন ক্ষমতা বাড়বে, একই সঙ্গে এর ফলে বাংলাদেশ যেসব সুযোগ হারাবে, তা মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি খাতকে পার্টনার হিসেবে কাজ করতে হবে।

বিইআইওএ’র সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং একটি ক্রস কাটিং খাত এবং এ খাতের উন্নয়ন হলে অন্যান্য শিল্প খাতের সুযোগ বাড়বে। তিনি জানান, সারাদেশে এ খাতের প্রায় ৪০-৫০ হাজার উদ্যোক্তা রয়েছে, তবে এ খাতের উদ্যোক্তারা শিল্প-কারখানা স্থাপনে জমি সংকটে রয়েছে।

মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, বর্তমানে পাট খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হলেও বর্তমান সময়ে টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি সামনে আসায় এ খাত থেকে ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করা সম্ভব।

নাইমুল হুদা বলেন, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের পরও ওষুধ শিল্পে প্যাটেন্ট সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে এবং বাংলাদেশ বর্তমানে ১১০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। তিনি দেশের ড্রাগ কর্তৃপক্ষকে আরও দক্ষ জনবল ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণের আহ্বান জানান।

এফএইচ আনসারী বলেন, কৃষি খাতে আমরা মোটামুটি সবকিছুই আমদানি করছি। দেশের জনগণের চাহিদা মেটাতে ৭০ শতাংশ জমিতেই ধান উৎপাদন করতে হয়, যেখানে কৃষি খাতে কর্মরত মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ জড়িত। এ জন্য কৃষি খাতে গবেষণা বৃদ্ধি ও নতুনত্ব ও প্রযুক্তি আনায়ন এবং পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে।