নাইমুর রহমান শাওন : পবিত্র মাহে রমজান আসন্ন। পবিত্র মাহে রমজান ধর্মপ্রাণ মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বিশেষ নেয়ামত। সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য এটি সংযম, নাজাত এবং পাপমুক্তির মাস। কিন্তু পবিত্র রমজান কাছে এলেই আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা যেন একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে প্রতি বছর রমজান এলেই আমাদের দেশের জনগণকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয়। যার ফলে জনজীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক। রমজান মাস নাজাতের মাস হলেও আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে জনগণের কাছে তা আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়; যেটি একজন মুসলমান হিসেবে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের অমীয় বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া পবিত্র মাহে রমজান মুসলিম জাহানে খুশির বার্তা নিয়ে আসে। মাসব্যাপী চলা রোজার মাসে ইবাদত বন্দেগির পাশাপাশি মানুষের খাদ্যাভাস ও সামগ্রিক জীবনধারায় পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই রমজানে কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যায়।
এগুলোর মধ্যে তেল, ডাল, চিনি, ছোলা, খেজুর, মসলা, ফলমূল, জামাকাপড় অন্যতম। এ অতিরিক্ত চাহিদাকে পুঁজি করে প্রতি বছর পবিত্র মাহে রমজানকে সামনে রেখে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুতদারের আবির্ভাব ঘটে। তাদের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যোগদান করে। পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু এসব অসাধু সিন্ডিকেটের যোগসাজশে ও মজুতদারির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং মূল্য বৃদ্ধি করে। যার ফলে তারা অধিক হারে মুনাফা লুটে নেয়। ফলস্বরূপ তা দেশের সীমিত আয়ের জনগণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রমজান এলেই দেশের জনগণ এদের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে যায়। নি¤œমধ্যবিত্ত ও দারিদ্র্য মানুষের কাছে যেটি একপ্রকার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও যাদের দৈনিক বা মাসিক আয় নির্দিষ্ট, পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। কারণ, রমজানে এসব মানুষের আয় বৃদ্ধি পায় না; বরং অনেকের আয় আরও কমে যায়।
অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীদেও একটি মনোভাব প্রচলিত আছে, রমজানের এক মাস ব্যবসা করব এবং বাকি সারা বছর আরামে কাটাব। যার কারণে তারা রমজান মাসে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে চায়। দাম বাড়ানোর প্রশ্নে খুচরা বিক্রেতারা দোষ চাপায় পাইকারি বিক্রেতাদের ওপর, পাইকারি বিক্রেতারা দোষ চাপায় আমদানিকারকদেও ওপর। আবার আমদানিকারকরা কারণ হিসেবে বলেন, আমদানি মূল্য, পরিবহন ব্যয়, চাঁদাবাজি। এভাবে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সবার দায় এড়িয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যায়, সেটি একপ্রকার দায়হীনতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আবার ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করলেও ওই পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলেও তাদের বাড়ানো দাম আর কমে না। রহমতের মাস রমজান এলে বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিমপ্রধান দেশে যেখানে দ্রব্যমূল্যের দাম কমানো হয়, সে তুলনায় আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।
অধিকন্তু, যেখানে খোদ ইসলাম ধর্মে অতিরিক্ত মূল্য আদায়কে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মজুতদারদের সম্পর্কে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, মজুতদার খুব নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হ্রাস পায়, তাহলে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর দাম বেড়ে গেলে তারা খুশি হয় ( মেশকাত)। ইসলাম মুনাফাখোরি, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও দালালির মতো কার্যক্রমকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
দেশে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যে দামের বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয়। কৃষক যে মূল্যে পণ্য বিক্রি করে তার কয়েকগুণ বেশি মূল্য দিয়ে ভোক্তাকে ওই একই পণ্য কিনতে হয়। আর মধ্যখানে এ কয়েকগুণ অতিরিক্ত মুনাফা যাচ্ছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী এবং মজুতকারীদের পকেটে। এসব অসাধু সিন্ডিকেট ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার এবং প্রশাসন মাঠে সক্রিয় থাকলেও বাস্তবে তার কোনো ফলাফল প্রতীয়মান হয় না। মূল্য বৃদ্ধি পেতেই থাকে। নানান বৈঠক, আলাপ-আলোচনা হলেও সেগুলো শুধু খাতাকলম এবং চার দেয়ালের ভেতর আবদ্ধ থেকে যায়, আলোর মুখের দেখা মেলে না খুব একটা। প্রতি বছর রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নানা রকম অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু বরাবর দেখা যায়, কোনো এক অজানা কারণে বাজারের নাটাই সরকারের হাতে থাকে না। বাজারের নাটাই থাকে কোনো এক অশুভ ব্যবসায়ী চক্রের হাতে। যার ফলে তারা সরকারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি মেনে চলে না। তারা তাদের নিজেদেও ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে একপ্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করে।
রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তও এবং প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। যদিও এটি প্রশংসার দাবিদার কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় তা পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করতে হবে এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে কোনো পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী ঘাটতি থাকলে আগাম সেটি আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। টিসিবির পণ্যের বরাদ্দ ও বিক্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি করতে হবে ও সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকেও ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
পবিত্র মাহে রমজানের মহিমায় অতি মুনাফালোভী, মজুতদার, অসাধু ব্যবসায়ী এবং সিন্ডিকেটকারীদের আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হোক। পরিশেষে বলতে চাই, রমজানের রোজা রেখে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক ও আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হয়ে সব রকম পাপ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবার আত্মা জেগে উঠুক।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়