রাজধানী ঢাকা কি ক্রমেই বাস-অযোগ্য হয়ে উঠছে?

রেজাউল করিম খোকন

(গতকালের পর)

শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দখল করে আছে দোকানপাট। শুধু তা-ই নয়, যখন-তখন যে কেউই তাদের ইচ্ছামাফিক শহরের ফুটপাতে দোকান তুলছেন, পসরা সাজাচ্ছেন। এই দখল প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই উচ্ছেদের জায়গাগুলো আবার দখল হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, হকারদের পুনর্বাসন ছাড়া ফুটপাত পথচারীবান্ধব করা যাবে না। এই শহরে সারি সারি ভবন আর রাস্তাঘাটের বিস্তৃতি ঘটছে, কিছু এলাকার চাকচিক্য সৌন্দর্য বাড়ছে; তবে সেই তুলনায় বস্তির কোনো উন্নয়ন হয়নি, সুযোগ-সুবিধাও বাড়েনি। অথচ ভোটের আগে ঢাকার দুই মেয়রই বস্তি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণÑদুই সিটি করপোরেশনের খেলার মাঠগুলোর বেহাল অবস্থা খুব সহজেই চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মাঠগুলো নজরদারি করার কেউ নেই। খেলার মাঠে নেই খেলাধুলার পরিবেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ধানমন্ডি এলাকায় একটি খেলার মাঠকে নিয়ে দারুণ তোলপাড় হয়েছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে খেলার মাঠটি আবার শিশুদের খেলাধুলার জন্য ফিরে এসেছে তাদের কাছে। ঢাকা নগরীর বিভিন্ন জায়গায় এরকম বহু খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে, কিংবা বেদখল হয়ে গেছে। শিশু-কিশোররা খেলার মাঠের অভাবে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে। তাদের যথার্থ মানসিক, শারীরিক গঠন ও বিকাশ ঘটছে না, যে কারণে কিশোরদের গ্যাং কালচারের দৌরাত্ম্যে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা শহরে খেলার মাঠের অভাব দূর করতে হবে। এজন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সংযুক্ত করে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আসলে যানজট, জলজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়টির দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারছে না। ওষুধ ছিটানোর পরও ঢাকায় মশার উপদ্রব কমেনি। মশার উপদ্রবের কথা দুই মেয়রই স্বীকার করেছেন। মশার যন্ত্রণা ঢাকা শহরবাসীর জীবনে চরম অস্বস্তি হয়ে আছে এখনও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

রাজধানীর দুই সিটি সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ প্রথাগত দরপত্র আহ্বানের পরিবর্তে অনলাইনে ই-টেন্ডারের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এটা একটা পজিটিভ দিক সন্দেহ নেই। ফলে দরপত্র নিয়ে স্বজনপ্রীতির আশঙ্কা কমেছে অনেক। এজন্য কাজকর্মে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মেয়রের সাহসী পদক্ষেপের ফলে গাবতলী, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন জায়গা অবৈধ পার্কিংমুক্ত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, কয়েক হাজার অবৈধ বিল বোর্ড উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে, ময়লা-আবর্জনা ফেলার হাজার হাজার ডাস্টবিন বসেছে পুরো নগরজুড়ে, সড়কে বসেছে আধুনিক এলইডি বাতি, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় নগরজুড়ে অনেকগুলো গণশৌচাগার নির্মিত হয়েছে এবং এগুলো ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য কয়েকটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে, পথেঘাটে নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত জীবাণুমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে বিশেষ ধরনের প্রায় ৫০০টি গাড়ি বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে। এই সাফল্য ও কৃতিত্বের জন্য দুই মেয়রকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। তাদের শক্তিশালী নেতৃত্বে দুই সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে আরও গতি আসবে আশা করি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ঢাকার দুই মেয়রের কাজকর্মকে জনগণ সমর্থন জানিয়েছেন। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও প্রশাসনিক কাজে তারা এখনও পিছিয়ে আছেন। এজন্য সব কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তা হলে বড় বড়  সমস্যাকে আর পাহাড়-পর্বতের মতো মনে হবে না, সহজেই সমাধান করা যাবে। দুই সিটি মেয়র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ঢাকা নগরীর বিদ্যমান সমস্যা, সংকট, অব্যবস্থা, অনিয়ম ও অসুন্দর দূরীকরণে নানা অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তারা ঠিকই উপলব্ধি করেছেন, কাজগুলো রাতারাতি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য সময় লাগবে। বেশ কিছুটা সময় তারা পার করেছেন এর মধ্যেই। তাদের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের অবকাশ নেই কারও। তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে এক সুতোয় বাঁধার, অর্থাৎ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর এখন একটি দর্শনহীন, ভিশনহীন ও সমন্বয়হীন দূষিত নগরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট নগরদর্শন, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এ শহর নিয়ে আমাদের সামনে স্পষ্ট কোনো ভিশনও নেই। নগরীতে পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার, দূষণমুক্ত পরিবেশ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ড্রেনেজ সমস্যার সমাধানসহ নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে সিটি করপোরেশনগুলো। যত্রতত্র গড়ে উঠছে শপিং সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বাণিজ্যিক কার্যালয়। আবাসিক এলাকাগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ঝুলন্ত তারের নগরীতে পরিণত হচ্ছে শহরগুলো। মাস্টারপ্ল্যানের বাইরে মার্কেটগুলোয় অননুমোদিত দোকানপাট তুলে অরাজকতা তৈরি করছে কিছু অসাধু চক্র। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে, পানিবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। কি বৃষ্টি কি বর্ষাকাল, যে সংস্থার যখন খুশি রাস্তা কাটাছেঁড়া করছে। পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নাকি ওয়াসার, তা নিয়ে চলে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সাধারণত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারে না সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্মে নিয়োজিত এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আমরা সব সময়েই প্রত্যক্ষ করে আসছি। এটাকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটাতে দুই মেয়রই তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রয়োগ করবেন আশা করি। এই নগরীকে স্বপ্নের মতো সুন্দর, বাসযোগ্য ও আরামদায়ক করতে প্রত্যেক নগরবাসীর নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে সেই দায়িত্বগুলো পালন করে গেলে আমাদের এই প্রিয় শহর কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারে না, বিশ্বের বাসের অযোগ্য শহরের কিংবা দুর্ভোগের শহরের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে না।

জনপ্রিয় ও আলোচিত ব্যান্ড চিরকুটের বিখ্যাত শ্রোতাপ্রিয় একটি গান রয়েছে  এই শহরকে  নিয়েÑ

এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকা রে…

এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর আহা রে…

এখন বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহর, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শহর, বিশ্বে বাসের অযোগ্য শহর কিংবা দুর্ভোগের শহর, যানজটের শহর, ব্যয়বহুল জীবনযাপনের শহর প্রভৃতি তকমায় ভূষিত হয় আমাদের সবার প্রাণের শহর প্রিয় ঢাকাকে। এর চেয়ে  কষ্টের অনুভূতি আর কী হতে পারে? দুঃস্বপ্নের বোঝা আর অনাগত বিপদের শঙ্কা বুকে বয়ে আমরা আমাদের প্রতিটি দিন পার করতে চাই না আর। অনেক সম্ভাবনা ও সুন্দরের হাতছানি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের প্রিয় এই রাজধানী ঢাকা শহর দুঃস্বপ্ন কিংবা দুর্ভোগের শহর হিসেবে বিবেচিত হোকÑআমরা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। আমরা মনেপ্রাণে চাই, একটি চমৎকার বাসযোগ্য স্বস্তিকর জীবনের শান্ত সুনিবিড় আন্তর্জাতিক মানের শহর হিসেবে ঢাকা গণ্য হোক বিশ্বজুড়ে। [শেষ]

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক