রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতির নামে হলে ব্লক দখল নীরবে চলে সিট বাণিজ্য

মনির হোসেন, রাবি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রদের জন্য হল রয়েছে ১১টি। প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগের কর্মী রাখার নাম করে হলগুলোয় ব্লক দখল করে নীরবে সিট বাণিজ্য করে যাচ্ছেন হল শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী।

সাংগঠনিক কাজকে গতিশীল রাখতে প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগের কর্মী প্রয়োজন। ফলে ছাত্রদের ১১টি হলেই হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারির নামে রয়েছে আলাদা ব্লক। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হলে আলাদা ব্লক থাকাটা কতটা যৌক্তিকÑএমন প্রশ্ন অনেকের। এসব ব্লকগুলোয় শুধু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই থাকতে পারবেন। কিন্তু ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী রাখার অজুহাতে টাকার বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে তুলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন নেতাকর্মীরা। এসব ব্লকে থাকা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই হল কার্ড নেই বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত দুই বছরে সর্বশেষ মাদারবক্স হলে নামমাত্র অ্যালটমেন্ট দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া আর কোনো হলেই অ্যালটমেন্ট দেয়া হয়নি। শিক্ষার্থীরা হল প্রভোস্টের কাছে সিটের জন্য আবেদন করে হলের রুম বরাদ্দ পেলেও ছাত্রলীগের কারণে হলে উঠতে পারছেন না।

টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের ব্লকে ওঠা কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, হলে তুলে দেয়ার নাম করে প্রথমে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়া হয় তাদের কাছ থেকে। পরে তাদের কিছুদিন থাকতে হয় ছাত্রলীগের এসব ব্লকে। এসব ব্লকে থাকাকালে ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করতে তাদের বাধ্য করা হয়, যদিও টাকার বিনিময়ে হলে ওঠায় এসব মিটিং-মিছিলে যেতে বাধ্য নয় তারা। একপ্রকার চাপে পড়েই যেতে হয় তাদের। কিছুদিন থাকার পর অন্য ব্লকে সিট ফাঁকা হলে তাদের পাঠানো হয় সেখানে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, তাদের একনিষ্ঠ অনেক  ছাত্রলীগ কর্মী আছেন, যারা সংগঠনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা হলে সিট পাচ্ছেন না। প্রতিটি হলে তাদের ছাত্র সংগঠনের জন্য থাকা ব্লকগুলোয় ৮-১০ হাজার টাকার বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে তুলছেন। এর ফলে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মনে বর্তমান কমিটির ওপর ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি হলের হলের মধ্যে পাঁচটি হলের দেয়ালে প্রকাশ্যেই ‘প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি ব্লক’ লেখা রয়েছে। আর বাকি হলগুলোর দেয়ালে প্রকাশ্যে লেখা না থাকলেও সভাপতি-সেক্রেটারির ব্লক আলাদাভাবে চিহ্নিত করা রয়েছে।

টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের ব্লকে ওঠা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাকে হলে তুলে দেয়ার কথা বলে সাত হাজার টাকা নেন এক নেতা। আমাকে রুম দেয়ার কথা বলে ছাত্রলীগের ব্লকে রাখে। প্রতিনিয়ত মিটিং-মিছিলে আমাকে জোর করেই নিয়ে যেতেন তারা। ছয় মাস থাকার পর একটা ফাঁকা সিট পেয়ে আমাকে অন্য জায়গায় শিফট করেন। ছাত্রলীগ নেতার নাম জানতে চাইলে বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন বলেন, টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের ব্লকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোলার ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। এটা আমাদের জন্য এবং আমাদের সংগঠনের জন্য একটি অশনিসংকেত। ছাত্রলীগের ব্লক থাকা সত্ত্বেও আমাদের কর্মীরা হলের সিটে উঠতে পারছেন না। এমন কর্মকাণ্ডে আমাদের সংগঠনও প্রশ্নবিদ্ধ বলে জানান তিনি।

শহিদ জিয়াউর রহমান হলের দ্বিতীয় ব্লকের তৃতীয় তলার দেয়ালে বড় করে লেখা রয়েছে ‘সেক্রেটারি ব্লক’। লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, আমি ব্লক দখল করেছি, বিষয়টা এমন নয়। আমরা যারা ছাত্রলীগ করি সবাই পাশাপাশি থাকি। তাই অনেকে মনে করেন আমরা ব্লক দখল করে আছি। যেহেতু ব্লকে আমরা সবাই পাশাপাশি থাকি, তাই সেক্রেটারি ব্লক লেখা হয়েছে।

ব্লকে ছাত্রলীগের কর্মী না তুলে টাকার বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোলার অভিযোগে তিনি বলেন, যখন আমি একটা ব্লকে আছি, তখন সেটা আমার ব্লক নামে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ যদি ব্লক দখল করে সিট বাণিজ্য করে, সেটা অবশ্যই বড় ধরনের অপরাধ। আমি এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই বলে জানান তিনি।

ব্লক দখল করে ছাত্রলীগের কর্মী তোলার নাম করে নীরবে সিট বাণিজ্য করে যাওয়ার বিষয়ে শহিদ শামসুজ্জোহা হলের সভাপতি চিরন্তন চন্দের কাছে জানতে চাইলে তিনি ১০ মিনিট পরে ফোন করবেন বলে ফোন কেটে দেন। পরে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।

নীরবে সিট বাণিজ্যের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, চুপিসারে অনেকেই সিট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে, তবে আমরা এমন কোনো তথ্য পাইনি। যদি কারও বিরুদ্ধে তথ্যসহ প্রমাণ পাই, তাহলে অবশ্যই দল থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হলের ব্লক দখল করা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হল কারও বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবেই ব্লক দখল করে আছে। আমার হলের দেয়ালেও সভাপতি-সেক্রেটারির নামে আলাদা ব্লক লেখা রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে অনেকবার তদন্ত করি। এখানে যারা থাকে অধিকাংশই হলের অবৈধ শিক্ষার্থী। এসব ব্লকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবাসিকতা প্রদান করা হলেও তারা তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে উঠতে দেয় না। হল প্রশাসনও একরকম তাদের কাছে জিম্মি বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ শামসুজ্জোহা হলের প্রভোস্ট ড. মো. একরামুল ইসলাম বলেন, হলে ছাত্রলীগের আলাদা ব্লক বলতে কিছু নেই। কোনো সংগঠনের আলাদা ব্লক থাকাটা কাম্য নয়। হল সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান। হলে যদি এমন কোনো পলিটিক্যাল ব্লক থাকে তাহলে অবশ্যই তা অপরাধ। অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা হলে অভিযান চালাব বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, কোনো ছাত্র সংগঠনেরই হলে ব্লক দখল করে রাজনীতি করা যৌক্তিক নয়। এসব দখলকৃত ব্লক উদ্ধার করার জন্য আমরা হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। আগামীতে আমরা হলে অভিযান চালিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করব বলে জানান তিনি।