চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংক

রাজনৈতিক বিবেচনার ব্যাংক লুট রাজনৈতিকভাবেই

মো. সুলাইমান: পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হয়। এসব ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার সময়ে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন পক্ষের মত উপেক্ষা করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলো বাজারে আসার পর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। ফলে দেশের ব্যাংক খাতে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোর কোনোটির আর্থিক অবস্থাই ভালো যাচ্ছে না। কয়েকটির অবস্থা খুবই খারাপ।

জানা গেছে, প্রবাসী আয় আহরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা এবং সেবায় নতুনত্ব আনার শর্তে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংকের অনুমোদনের আলোচনার শুরুতেই ব্যাপক সমালোচনা করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে সবকিছু উপেক্ষা করে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক চাপে বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়ম তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র লুকানো ছিল। এক্ষেত্রে অনিয়ম দেখেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাধীনভাবে পরিদর্শন করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। আগে বছরে ৩০ ডিসেম্বর এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ৪ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বা ৮১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ প্রজšে§র ব্যাংকগুলোর অর্থ যারা লুট করেছে, তারা বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক শক্তিশালী ছিল। তারা প্রভাব খাটিয়ে নানা সময়ে লুট করা টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আবার অনেকে দেশের মধ্যে বিলাসি জীবনযাপন করেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যাংক লুটকারী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তাদের শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে ব্যাংক খাতে লুটের প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে না।

এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে তীব্র তারল্য সংকটে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক দুটিতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের পেছনে শুরুতে সামনে রাখা হয় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। তখন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এক জোট হয়ে সরকারে ছিল। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন এস আলমের ভাই শহীদুল আলম। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়েও ব্যাংকটি এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মু. ফরীদ উদ্দীন আহমদ শেয়ার বিজকে বলেন, লুটপাট হওয়া দুর্বল ব্যাংগুলোয় অনুসন্ধান চালাতে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী সপ্তাহ থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরীক্ষার কাজ শুরু হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের জানিয়েছে। এসব ব্যাংকে স্বাধীনভাবেই নিরীক্ষা করা হবে। এরপর প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ২১৭ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৪৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ ব্যাংকটি তীব্র অর্থ সংকটে রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের আগের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপির চিত্র।

২০১৩ সালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাপক ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর ২০২১ সালের শুরুতে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক রাখা হয়। পিকে হালদার বিভিন্ন নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকারের শেষ সময়ে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকেরও নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলমের হাতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৯২ শতাংশই খেলাপি। অথচ এ ব্যাংকটিও তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে। ইতোমধ্যে এই ব্যাংকেরও বোর্ড ভেঙে পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তদন্ত শেষে প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্স ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিগত সরকারের সময় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ছিল বিশেষ লক্ষণীয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এটি একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশ্যই দায় রয়েছে। অবৈধ সুবিধা নিয়ে যারা ব্যাংক খাতে অনিয়ম করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা নজির শুরু হয়েছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকে।

অপরদিকে মেঘনা ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৩০২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বিতরণ করেছে মিডল্যান্ড ব্যাংক। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মধুমতি ব্যাংকেও অনিয়ম হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১৩ সালে মধুমতি ব্যাংকের অনুমোদন নেন সাবেক ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। যদিও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে জনৈক হুমায়–ন কবিরকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে তাপস সব পর্ষদেই পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে তাপস পলাতক রয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মধুমতি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কারণ ৬ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ঋণের ৩২৮ কোটি টাকা খেলাপি।

এনআরবি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৫৭৩ কোটি টাকা; যা বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আলোচ্য এসব ব্যাংকের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা গা-ঢাকা দিয়েছেন। ফলে ব্যাংকগুলোয় একধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অনেক পরিচালক পদও হারাতে পারেন। কারণ তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে নানাভাবে ব্যাংকের অর্থ লুটপাট করেছেন। ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়ার সময়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছে। এসব ব্যাংক অনুমোদনের তিন বছরের মাথায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ শর্ত বেশির ভাগ নতুন ব্যাংক পূরণ করতে পারেনি। এককথায়, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে বাজারে আসা চতুর্থ প্রজšে§র ৯ ব্যাংক রয়েছে চরম সংকটে।