প্রতিনিধি, রাজবাড়ী: রাজবাড়ীতে উন্নয়নকাজে ব্যবহƒত সব ধরনের বালির দাম গত ছয় মাসে দ্বিগুণ হয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পসহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘরবাড়ি তৈরি ও নিচু জমি ভরাটের কাজ।
রাজবাড়ী সদরের ধাওয়াপাড়া ঘাট, মেছোঘাটা, গোদার বাজার ঘাট, সোনাকান্দর ঘাট ও উড়াকান্দা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার বড় বড় বালির চাতালগুলো বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। অথচ এক বছর আগেও রাজবাড়ী জেলার বালি যেত দেশের বিভিন্ন জেলায়। এখন এ জেলাতেই বালির চরম সংকট।
বালি ব্যবসায়ীদের দাবি, একদিকে জেলার পদ্মা নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ, অন্যদিকে বাইরের জেলা থেকে বালি এনে ব্যবসা করতে প্রশাসনের বাধার সম্মুখীন হওয়ায় জেলায় বালির সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে বালির বাজার। একইসঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বালিসংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার শ্রমিক।
তবে জেলা প্রশাসক বলছেন, অন্য জেলা থেকে বালি এনে ব্যবসা করতে ব্যবসায়ীদের কোনো বাধা নেই।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট লোকজন ও বালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পাবনার পাকশী পর্যন্ত পদ্মা নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধে নিষেধাজ্ঞা দেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে এসব এলাকার বালিমহালকে দেয়া ইজারা বাতিল করারও নির্দেশ দেন আদালত। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলার পদ্মা নদীর ছয়টি বালিমহাল ইজারা বন্ধ রাখে জেলা প্রশাসন। বালিমহাল থেকে উত্তোলন করা মজুত বালি দিয়ে এবং অন্য জেলা থেকে বালি কিনে এনে ছয় মাস জেলার বালির চাহিদা পূরণ করা গেছে। সেসময় বালির দামও স্বাভাবিক ছিল। তবে মজুত বালি শেষ হওয়ার পর এবং অন্য জেলা থেকে বালি আনা বন্ধ হওয়ায় ছয় মাস ধরে জেলায় বালির সংকট দেখা দিয়েছে। ছয় মাস আগে জেলার বালির চাতালগুলোয় প্রকারভেদে প্রতি ঘনফুট মোটা বা আস্তর বালির দাম ছিল ছয় থেকে ১০ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৮ টাকায়। আর তিন টাকা ঘনফুটের ভরাট বালি বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আট টাকায়।
রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিল্ডিং ডিজাইন ও নির্মাণের কাজ করেন প্রকৌশলী রাশেদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, রাজবাড়ী জেলায় বালির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। যে কারণে গত ছয় মাসে বালির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। অনেক সময় টাকা দিয়েও ভালো মানের বালি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আমাদের নির্মাণকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
রাজবাড়ী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্স সজ্জনকান্দা জমিদার সড়ক এলাকায় ব্যাক্তিগত বিল্ডিং নির্মাণ করছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বালির দাম অনেক বেড়েছে। তাছাড়া ভালো বালিও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজ আপাতত বন্ধ রেখেছি। বালির দাম কমলেও ভালো বালি পাওয়া গেলে আবার কাজ শুরু করব।
মেছোঘাটা এলাকার বালি ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলার পদ্মা নদীর বালিমহালগুলো ইজারা বন্ধ রেখেছে জেলা প্রশাসন। এতে পদ্মা নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। তবে বালি উন্নয়ন কাজের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হওয়ায় এর চাহিদা কমেনি। রাজবাড়ী জেলায় প্রতিদিন মোটা ও ভরাট বালি মিলিয়ে অন্তত দুই লাখ ঘনফুট বালির চাহিদা রয়েছে। বালির চাহিদা পূরণে আমরা বাল্কহেডে করে মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ থেকে বৈধভাবে বালি এনে বিক্রি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন এতে বাধা দেওয়ায় আমরা অন্য জেলা থেকে বালি আনতে পারছি না। যে কারণে জেলায় বালির সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বালির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বালি সংশ্লিষ্ট বাল্কহেড শ্রমিক, ড্রেজার শ্রমিক, ভেকু শ্রমিক, ট্রাক শ্রমিক, চাতাল শ্রমিকসহ কয়েক হাজার শ্রমিক।
বাল্কহেডের সুকানি আরিফ শেখ বলেন, বাল্কহেডে বালি পরিবহন বন্ধ থাকায় আমরা শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছি। খুব কষ্টে দিনযাপন করছি। আমাদের কষ্টের কথাগুলো শোনার কেউ নেই।
ভেকু চালক বাবু সরদার বলেন, চাতালে বালি না থাকায় আমরা ভেকু চালাতে পারছি না। বেকার হয়ে বসে আছি। এতে ভেকুর মালিকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরাও খুব কষ্টে দিনযাপন করছি।
চাতাল শ্রমিক উম্বার খা বলেন, বালির চাতালে কাজ করে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতাম। কিন্তু চাতালে এখন বালি নেই, যে কারণে সংসার চালাতে পারছি না। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। অন্য কোনো কাজও পারি না যে সেই কাজ করে জীবিকা চালাব। আমরা চাই পুলিশ ও প্রশাসন বাল্কহেডে অন্য জেলা থেকে বালি এনে ব্যবসা করার জন্য ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিক। এতে বালির চাহিদাও পূরণ হবে, দামও কমবে, আমরা শ্রমিকরাও খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারব।
এ বিষয়ে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান বলেন, রাজবাড়ী জেলার সীমানার মধ্যে পদ্মা নদী থেকে বালি উত্তোলন করা যাবে না। তবে অন্য জেলা থেকে বৈধ পন্থায় বালি কিনে এনে ব্যবসা করতে ব্যবসায়ীদের কোনো বাধা নেই।