রাজশাহীতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস

আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী: রোগাক্রান্ত পশুর বাসি ও পচা মাংসের ছড়াছড়ি রাজশাহীর বাজারে। প্রতিনিয়িত এসব মাংস কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। বিশেষজ্ঞরা জানান, এ মাংস খেয়ে মানুষের হƒদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, পায়ে পানি জমা, লিভারে চর্বি জমা, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন সব জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে তা নিষ্ক্রিয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহের ছয় দিন সাহেব বাজার, নিউমার্কেট, নওদাপাড়া, কোর্ট স্টেশন, লক্ষ্মীপুর, শালবাগান ও কাজলা বেতারের মোড় ও কাটাখালী বাজারে পশু জবাই হয়। প্রতি শুক্রবার মহানগরীতে অন্তত আড়াইশ’ থেকে ৩০০ গরু জবাই হয়। এছাড়া ছাগল, মহিষ ও ভেড়া তো রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ পশু বাইরে থেকে জবাই করে বাজারে আনা হয়। কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই গরুপ্রতি ২০ টাকা, মহিষ ৩০ টাকা, ছাগল বা ভেড়াপ্রতি পাঁচ টাকা আদায় করে পশুর গায়ে সিল মারা হয়। এতে করে সুস্থ না কি অসুস্থ পশু পার্থক্য করার উপায় থাকে না।
আশরাফুজ্জামান ফয়সাল নামে এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, মহানগরীতে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষই আমিষের চাহিদা পূরণে মাংস খান। কিন্তু বাজারে মাংস কিনতে গিয়ে প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন তারা। রোগাক্রান্ত ও মরা গরু ও ছাগলের মাংসে ছেয়ে গেছে বাজার। শুধু তাই নয় কখনও কখনও বাসি ও পচা মাংস বিক্রি হয়। জবাই করা পশুর যেসব অংশ মানুষের খাবার অযোগ্য সেগুলো এখন আর বাদ দেওয়া হয় না। মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। রাসিকের কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। শুধু পশুর গায়ে রাসিকের সিল মেরে সুবিধা আদায় করা হয়। রাসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভেটেরিনারি কর্মকর্তাদের বাজারে পশু ও মাংস পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও তা করে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ক্রেতা জানান, কোনো পশু অসুস্থ হলে পশুর মালিক মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই পশুর আনুমানিক মূল্য ৫০ হাজার টাকা হলেও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় কেনে মাংস ব্যবসায়ীরা। এরপর জবাই করে বাজারে মাংস বিক্রি করা হয়। তবে এর অধিকাংশই চলে যায় স্থানীয় খাবার হোটেলে।
পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১১-তে বলা হয়েছে, যে কোনো পশু জবাইয়ের আগে পশুটি যে সুস্থ সবল তার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ভেটেরিনারি কর্মকর্তার ঘোষণা থাকতে হবে। পশু জবাইয়ের পর ভেটেরিনারি কর্মকর্তার মাধ্যমে বিধি মোতাবেক যথাযথভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এই বিধান লঙ্ঘন করলে ভ্রাম্যমাণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী, অনূর্ধ্ব এক বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার এবং অনূর্ধ্ব ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করেই অবাধে বিক্রি হচ্ছে অসুস্থ পশুর মাংস। এছাড়া মাঝে মধ্যেই নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে মাংস বিক্রি করা হয়।
এ ব্যাপারে রাসিকের ভেটেরিনারি সার্জন ফরহাদ উদ্দিন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মহানগরীতে না থাকার কারণে সঠিকভাবে পশু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। এসব মাংস খেয়ে মানুষের হƒদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, পায়ে পানি জমা হওয়া, লিভারে চর্বি জমা হওয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন সব জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মহানগরীর সাতটি বাজারে তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল রয়েছে, যারা এ বিষয়টি মনিটরিং করেন বলে দাবি করেন তিনি। এছাড়া বর্তমানে রাসিকে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মাঝে মধ্যেই রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা এবং সেখানে সহযোগিতার কথাও বলেন তিনি।
সার্জন ফরহাদ আরও বলেন, নগরীর তালাইমারী এলাকায় এক একর জমির ওপর কেন্দ্রীয় কসাইখানার কাজ চলছে। এছাড়া সাহেব বাজারে কসাইখানার নকশা তৈরি হয়েছে কিন্তু সেখানে কয়েকটি দোকান অবমুক্ত করতে না পারার কারণে ওই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
মাংস বিক্রির এসব অভিযোগের বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সমিতির নেতাদের অজ্ঞাতে কিছু কিছু দোকানে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অধীন তাদের সমিতির ৩৩০ জন সদস্য রয়েছে। যত্রতত্র পশু জবাই করে বাজারে মাংস নিয়ে আসা হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে, মাংস ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো কসাইখানা নেই।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের বলেন, বাজারে রোগাক্রান্ত ও মরা গরু-মহিষ ও ছাগলের মাংস বিক্রি হলে সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে তিনি রাসিকের কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
এ ব্যাপারে রাসিক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, বাজারে পরীক্ষার পর পশুর মাংসে সিল মারা হয়। তবে যেসব পশু বাইরে থেকে জবাই হয়ে আসে সেগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। রাজশাহীর তালাইমারিতে এক একর জমির ওপরে প্রথম একটি আধুনিক কসাইখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে সীমানা প্রাচীরের কাজ শেষ হয়েছে। যেহেতু এটি একটি বড় পরিকল্পনা এ কারণে সাহেব বাজারের বিষয়টি পরে চিন্তা করা যাবে।