রাজশাহীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আমের ফ্রুট ব্যাগিং

মো. আব্দুল হাকিম, রাজশাহী : ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিতে আম চাষ রাজশাহী অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ পদ্ধতি আমচাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি মূলত আমের গায়ে বিশেষ ব্যাগ পরিয়ে দিয়ে চাষ করা হয়; যা ফলকে কীটপতঙ্গ, রোগ এবং অতিবৃষ্টির ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি পরিবেশ সংরক্ষণ ও ফলের গুণগত মান রক্ষায় এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে। এটি কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে আমের সুরক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে একটি কার্যকর সমাধান প্রদান করছে। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষিরা ফলের গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারেন এবং একই সঙ্গে পরিবেশের ওপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবও হ্রাস করতে সক্ষম হন।

চাষিরা আম সংগ্রহ করার পর থেকে পরের মৌসুমে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত ১৫-৬২ বার বালাইনাশক ব্যবহার করেন। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষেত্র বিশেষে ২-৫ বার স্প্রে করলেই ভালো মানের আম সংগ্রহ করা সম্ভব। অতিরিক্ত স্প্রে যেমন জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি আমের উৎপাদন ব্যয়বহুল করে তোলে। অতিরিক্ত স্প্রে করার ফলে উপকারী ও বন্ধু পোকামাকড়ের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের পরিবেশবান্ধব সমাধানের অন্যতম উপায় হলো ব্যাগিং প্রযুক্তি।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গাজীপুর ফল বিভাগের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (এইচআরসি) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন বলেন, ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা বয়সে বিশেষ ধরনের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায়। ব্যাগিং করার পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ব্যাগটি গাছেই ফলের সঙ্গে লাগানো থাকে। তবে এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রং এবং আকারের হয়ে থাকে। আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। রঙিন আমের জন্য সাদা ব্যাগ আর অন্যান্য জাতের জন্য বাদামি রংয়ের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।

তিনি বলেন, আমের কাক্সিক্ষত ফলন নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত স্প্রে যেমন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি আমের উৎপাদন ব্যয়ও বেশি। এ অবস্থায় আমে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বালাইনাশকের ব্যবহার ও খরচ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। এই ব্যাগিং পদ্ধতিতে প্রায় ৩০ থেকে জাতভেদে ৭০ শতাংশ বালাইনাশক কম হয়।

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সব জাতের আমের জন্য ব্যাগিং করার সময় এক নয়। যেমন বারি আম-১, বারি আম-২, বারি আম-৬, বারি আম-৭, ক্ষীরশাপাতি এবং ল্যাংড়া জাতের আমে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৪৫ দিন বয়সের গুটিতে। আমের অন্যান্য জাত যেমন বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-৮, ফজলি ও আশ্বিনা জাতে ব্যাগিং করা হয় গুটির বয়স ৬০-৬৫ দিন হলে। আমের প্রাকৃতিক ঝরা বন্ধ হলে এবং ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যাগিং করতে হবে। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। নির্দিষ্ট বয়সের এবং আকারের দাগমুক্ত আমে ব্যাগিং করতে হবে। একটি পুষ্মমঞ্জুরিতে অনেক আম থাকলে প্রথমেই ফল পাতলা করতে হবে। এরপর সবচেয়ে ভালো, দাগমুক্ত একটি অথবা দুটি আমে ব্যাগিং করতে হবে। তবে বড় জাতের আমের ক্ষেত্রে প্রতি পুষ্মমঞ্জুরিতে একটির বেশি ফল রাখা উচিত নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাগিং করা উৎপাদিত আম গাছ থেকে সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া যাবে না। সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে বা ২-১ দিনের মধ্যে খেলে কম মিষ্টি লাগবে। এই আমগুলো যত বেশি ঘরে রেখে খাওয়া যাবে ততই মিষ্টতা বাড়বে। সাধারণভাবে দেখা গেছে, জাতভেদে ব্যাগিংয়ের আম সংগ্রহের ৬-৭ দিন পর ভালোভাবে নরম হয় এবং খেতে সুস্বাদু হয়। কোনো অবস্থাতেই শুধুমাত্র রং বিবেচনা করে আম কাটা ঠিক হবে না। জাতভেদে আমগুলো ৯-১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যাবে।

আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আরএইচআরসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘ব্যাগযুক্ত ফলগুলো নন-ব্যাগযুক্ত ফলের তুলনায় অনেক ভালো। এ প্রযুক্তি পোকামাকড় এবং রোগের ক্ষতি কমাতে এবং আমের ফলের গুণমান ত্রুটিগুলো হ্রাস করতে সহায়তা করে। ফল ব্যাগিং পদ্ধতি ফল ও গাছের সুরক্ষার জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি।’

গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ফলকে তাজা ও দাগমুক্ত রাখে। তিনি এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভালো সুফল পেয়েছেন। তিনি ৩২ হাজার আমের ব্যাগিং করেছেন। যেখানে তার খরচ হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ টাকা।’

রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আম এই অঞ্চলের বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফল ফসলের মধ্যে একটি। তবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসলটি বিকাশের সব পর্যায়ে কীটপতঙ্গ এবং রোগের আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিটি আতঙ্ক দূর করার জন্য চাষি এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি উচ্চ আশা তৈরি করেছে।’

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন বলেন, ‘এ প্রযুক্তিটি ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে এখনও তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে যারা রপ্তানির জন্য আম উৎপাদন করছেন, তারা প্রয়োজনের তাগিদেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। বাণিজ্যিক বাগানগুলোয় এ পদ্ধতিতে জনপ্রিয়তা বেশি পেয়েছে। যে কোনো ভালো প্রযুক্তির সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগ আন্তরিক। তবে সব চাষিই যে এ প্রযুক্তি বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করবে এমনটা নয়। তবে সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদেই এ পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।’