এলটিইউ ভ্যাট

৬৬ প্রতিষ্ঠান ২ পদ্মাসেতুর ব্যয়ের সমান ভ্যাট দিয়েছে

রহমত রহমান: ২০২২-২৩ অর্থবছর বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) মূল্য সংযোজন করের রাজস্ব আদায় প্রথমবার অর্ধ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর এলটিইউ রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় ৫৮ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ছয় হাজার ১৩২ কোটি টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর আদায় করা রাজস্ব দুই পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান। আবার এলটিইউয়ের ১০টি খাতের ৬৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতো এবারও সিগারেট থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় হয়েছে। দেশের অর্থনীতি কিছুটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও এলটিইউয়ের অর্ধ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এনবিআর। এলটিইউ কর্মকর্তারা বলছেন, সিগারেট খাতে মনিটরিং, নিয়মিত দাখিল পরীক্ষা করে অবৈধ রেয়াত বাতিল, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, মামলা নিষ্পত্তি, নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে বকেয়া আদায়ে তাগিদ দেয়ার ফলে এই রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়েছে। এছাড়া এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী এলটিইউ টিম রাজস্ব আদায়ে নিরলস পরিশ্রম করেছে।

এলটিইউয়ের হিসাব অনুযায়ী, এলটিইউতে নিবন্ধিত ১১০টি প্রতিষ্ঠান বা ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ গ্রুপ অব কোম্পানির প্রতিষ্ঠান। এলটিইউ বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫৮ হাজার ৫৬৬ কোটি ছয় লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ছয় হাজার ১৩২ কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছর এলটিইউয়ের রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরে এ রাজস্ব আদায় বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। আবার প্রথমবারের মতো এলটিইউয়ের ভ্যাট আদায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর ১০টি খাতের ৬৬টি ইউনিট বা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৯০৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ১০টি খাত হলোÑসিগারেট, মোবাইল, গ্যাস, ওষুধ, ব্যাংক, বিদ্যুৎ, বেভারেজ, সোপ, সিমেন্ট ও বিটিআরসি।

সিগারেট: সিগারেট খাত এলটিইউয়ের রাজস্ব আদায়ের সর্ববৃহৎ খাত। এ খাত থেকে এলটিইউয়ের মোট রাজস্বের প্রায় ৫২ শতাংশ আহরিত হয়। এলটিইউয়ের আওতাধীন তিনটি সিগারেট কোম্পানি রয়েছে। তিনটি কোম্পানি থেকে বিদায়ী অর্থবছর রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩০ হাজার ৬০৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছর আদায় হয়েছিল ২৭ হাজার ৮৩০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর এ খাত থেকে দুই হাজার ৭৭৭ কোটি তিন লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। এ খাতের

 আদায় প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

মোবাইল: মোবাইল খাত এলটিইউয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তর খাত। এ খাত থেকে এলটিইউয়ের প্রায় ১৬ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। দেশের চারটি মোবাইল অপারেটর এলটিইউতে নিবন্ধিত। চারটি মোবাইল কোম্পানি থেকে বিদায়ী অর্থবছর রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ হাজার ৪২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৯০৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

গ্যাস: গ্যাস খাত থেকে এলটিইউ প্রায় সাত শতাংশ রাজস্ব আদায় করে থাকে। পেট্রোবাংলাসহ এ খাতের মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এলটিইউতে নিবন্ধিত। পাঁচটি গ্যাস কোম্পানি থেকে বিদায়ী অর্থবছর রাজস্ব আদায় হয়েছে তিন হাজার ৯৩৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৬৯৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

ওষুধ: ওষুধ খাত থেকে এলটিইউ প্রায় ছয় শতাংশ রাজস্ব আদায় করে থাকে। এলটিইউতে নিবন্ধিত ওষুধ কোম্পানি রয়েছে ১৮টি। ১৮টি ওষুধ কোম্পানি থেকে বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছে তিন হাজার ৭৪৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২৬৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ব্যাংক: এ খাত থেকে এলটিইউ প্রায় পাঁচ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে। এ খাতে নিবন্ধিত ব্যাংকের সংখ্যা ১৭টি। ১৭টি ব্যাংক থেকে বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছে তিন হাজার ১২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৫০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। আদায় প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

বেভারেজ: এলটিইউয়ের আওতাধীন চারটি বেভারেজ কোম্পানি রয়েছে। এই চারটি থেকে বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছে ৮৭২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা ২০২১ অর্থবছরের চেয়ে ১৯৪ কোটি ৯ লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ২৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।

সিমেন্ট: ৯টি সিমেন্ট কোম্পানি এলটিইউতে নিবন্ধিত। এই ৯টি থেকে বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছে ৫৩৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ১৫১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ৩৯ দশমিক ২১ শতাংশ।

অন্যদিকে একটি সাবান কোম্পানি থেকে বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছে ৬৮৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১০০ কোটি দুই লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। বিটিআরসি থেকে বিদায়ী অর্থবছর আদায় হয়েছে ৫৬২ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৩৫০ কোটি ২০ লাখ টাকা বেশি। আদায় প্রবৃদ্ধি ১৬৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। চারটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর আদায় হয়েছে এক হাজার ৪৭৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বিদায়ী অর্থবছর জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কম হয়েছে, যার ফলে এই খাত থেকে আদায় কমেছে ৭১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

এলটিইউয়ের বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার ফলে বিদায়ী অর্থবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑনিয়মিত দাখিলপত্র যাচাই, অবৈধ রেয়াত চিহ্নিত ও বাতিল করা, মামলা নিষ্পত্তি, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর), বকেয়া রাজস্ব আদায়, প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে বিদায়ী অর্থবছর এলটিইউ ৩৫৭ কোটি ১২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। এলটিইউ সব সময় প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র শতভাগ পরীক্ষা করে আসছে। বিদায়ী অর্থবছর দাখিলপত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ৬৬টি দাবিনামা জারি করা হয়েছে। যার বিপরীতে প্রায় ৫৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর ৯০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে, যার থেকে প্রায় ৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এছাড়া উচ্চ আদালতে বিচারাধীন গুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আদালতের সঙ্গে এ দপ্তর নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। বিদায়ী অর্থবছর ১৩টি মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে, যার থেকে প্রায় ৬৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। বকেয়া আদায়ে বিদায়ী অর্থবছর ৮৭টি দাবিনামা জারি করেছে, যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৯৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বিদায়ী অর্থবছর ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা।