রাজস্ব-খেলাপিদের ব্যাংক হিসাব লুকানোর সুযোগ বন্ধ হচ্ছে

রহমত রহমান: কখনও আমদানি-রপ্তানি। কখনও উৎপাদন বা সরবরাহ। আবার কখনও প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটায়। এভাবে প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব বকেয়া থেকে যায়। কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠান বকেয়া পরিশোধ করে দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বকেয়া রাজস্ব পরিশোধে গড়িমসি করে। প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়ে রাজস্ব-খেলাপি। ভ্যাট কমিশনারেট, কাস্টম হাউস ও বন্ড কমিশনারেট রাজস্ব আদায়ে বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করে। তবে ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেও বেশিরভাগ সময় রাজস্ব আদায় সম্ভব হয় না। যার মূল কারণ প্রতিষ্ঠান ব্যাংক হিসাব নিয়ে লুকোচুরি করে। এক প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যাংক হিসাব থাকে।

দেখা যায়, যে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে, সে হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা নেই। ফলে ব্যাংক হিসাব জব্দ করেও নিরঙ্কুশ বকেয়া আদায় সম্ভব হয় না। জব্দ করা হলেও প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যাংক হিসাবে প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সচল রাখে। মূলত রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য থাকে না। এবার প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য নেয়ার উদ্যোগ নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে থাকা সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য নেয়া হবে। এর ফলে একদিকে রাজস্ব খেলাপি থেকে নিরঙ্কুশ বকেয়া আদায় সম্ভব হবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সব তথ্য সংশ্লিষ্ট ভ্যাট অফিস, কাস্টম হাউস ও বন্ড কমিশনারেটের কাছে থাকবে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ‘নিরঙ্কুশ বকেয়া রাজস্ব আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট রাজস্ব খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপরিচালনযোগ্য (ফ্রিজ) করা’ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে এ চিঠি দেয়া হয়েছে।

 চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের রাজস্ব বকেয়া রয়েছে। নিরঙ্কুশ বকেয়া রাজস্ব আদায়ে কাস্টম হাউস, ভ্যাট ও বন্ড কমিশনারেট নানা উদ্যোগ নেয়। এর একটি হলো ব্যাংক হিসাব জব্দ বা অপরিচালনযোগ্য (ফ্রিজ)। কাস্টমস আইনের ২০২ ও মূসক আইনের ৯৫ ধারা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব জব্দের অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট তফসিলি ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হলো ব্যাংক হিসাব। রাজস্ব-খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কোন ব্যাংকে কয়টি ব্যাংক হিসাব রয়েছেÑতার প্রকৃত তথ্য ভ্যাট ও বন্ড কমিশনারেট বা কাস্টম হাউসের কাছে নেই। ফলে আমদানিকারকের ক্ষেত্রে কাস্টম হাউস বা বন্ড কমিশনারেট এলসিতে উল্লিখিত ব্যাংক হিসাব জব্দে চিঠি দেয়। আর উৎপাদনকারী বা সরবরাহকারীদের ক্ষেত্রে ভ্যাট বা বন্ড কমিশনারেট মূসক নিবন্ধন আবেদন ফরমে উল্লিখিত ব্যাংককে হিসাব জব্দে চিঠি দেয়। ফলে বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য কোনো রাজস্ব-খেলাপির যে ব্যাংক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়, কেবল সেই ব্যাংকের হিসাবটি ফ্রিজ হচ্ছে। কিন্তু অন্য ব্যাংকগুলোয় প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা হিসাব সচল থাকছে। এসব হিসাব ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ফলে কোনো প্রতিষ্ঠানের এক বা একাধিক ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অনাদায়ী বকেয়া রাজস্ব আদায় করা যায় না। বছরের পর বছর বকেয়া রাজস্ব অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে।

এ পদ্ধতি অবলম্বন করে রাজস্ব খেলাপি প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সুফল পেয়েছে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ২০১৪ সালে ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেট ভালো ফল পেয়েছে। সেখানে কয়েক মাসে রাজস্ব-খেলাপি প্রায় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস রাজস্ব খেলাপি প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করে; যার মাধ্যমে বকেয়া আদায়ে আশাব্যঞ্জক ফলাফল পেয়েছে। এক্ষেত্রে সমস্যাও রয়েছে। দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আলাদা আলাদা চিঠি দিতে হয়; যাতে রাজস্ব খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-টিআইএন ও বিআইএনের বিপরীতে খোলা সব ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করতে অনুরোধ করা হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

তবে কোনো রাজস্ব-খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-টিআইএন, বিআইএনের বিপরীতে দেশের কোনো ব্যাংকে কতগুলো ব্যাংক হিসাব রয়েছেÑতার তথ্য ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ থেকে পাওয়া গেলে অথবা রাজস্ব খেলাপি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামে বিদ্যমান সব ব্যাংক হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় কেন্দ্রীয়ভাবে জব্দ (ফ্রিজ) করা গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতে বাধ্য হবে। এতে নিরঙ্কুশ বকেয়া রাজস্ব আদায় করা অনেক সহজতর হবে। এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে এনবিআরকে সহযোগিতা করতে পারে; সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত চাইতে পারে। অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি সভা করে করণীয় নির্ধারণ করার অনুরোধ জানানো হয়।

এই বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, বকেয়া রাজস্ব আদায়ে প্রতিষ্ঠানের দেয়া ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান যে ব্যাংক হিসাব প্রদর্শন করে না, সেগুলো জব্দ করা জটিল। ফলে প্রতিষ্ঠানের একটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হলেও অন্য একাধিক হিসাব থেকে প্রতিষ্ঠান লেনদেন করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা গেলে বিপুল বকেয়া রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে। আশা করি, এনবিআর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, মামলার জালেই আটকা বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। মাঠপর্যায়ের ১২টি ভ্যাট অফিসের অধীনে আট হাজার ৭৪৫টি মামলার বিপরীতে ওই টাকা দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী অবস্থায় আছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত ভ্যাট, বন্ড কমিশনারেট, কাস্টম হাউসে রাজস্ব-খেলাপির সংখ্যা বেড়েই চলেছে।