সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বিচার বিভাগের আলোচিত বিষয় ছিল পাটকল শ্রমিক জাহালমকে নিয়ে। কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়েও ভয়ংকর ঋণখেলাপি হিসেবে ৩৩টি মামলার শিকার হয়েছেন জাহালম। সেই মামলায় তিন বছর বিনা বিচারে জেলে আটকও থাকতে হয়েছে। জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে খবর ছাপা না হলে তাকে যে কত বছর জেলে ঘানি টানতে হতো, কেউ বলতে পারে না। অথচ ঋণ নিয়েছিলেন জনৈক আবু সালেক। দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সালেকের স্থলে জাহালমকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
জাহালমকে নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর তা হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। শুনানি নিয়ে আদালত ওই আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। বিনা কারাভোগ, আবার বিচারে দোষী হয়েও কারাভোগ না করার দৃষ্টান্তও নেহাত কম নয়। শেষ পর্যন্ত বিচার পেয়েছেন জাহালম। কিন্তু কোনোভাবেই এটিকে বিচারের স্বাভাবিক গতি বলা যাবে না।
অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি করতে দেশের আইনি ব্যবস্থায় নিñিদ্র প্রতিকার নেই। আইনের স্বাভাবিক গতির জন্য প্রশাসনের নীতিগত দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী। এ দুর্বলতা দূর করা ছাড়া ন্যায়বিচার কায়েম করা সম্ভব নয় বলেই মনে করি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো যাচাই করলে দেখা যাবে মামলার বেড়েছে বই কমেনি। বিলম্বিত বিচার মানেই অবিচার। আবার দ্রুত বিচারেও ভুল বিচারের আশঙ্কা থাকে। বিলম্বিত বিচারের দায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিচার বিভাগও দায় এড়াতে পারে না। বিলম্বিত বিচার মানে বিচারকে অস্বীকার করা। অবশ্য চাঞ্চল্যকর মামলাও আদালতের কিংবা সরকারের নির্দেশে স্থগিত থাকে। সংবাদ প্রকাশের পর তা সচলের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সংবিধান অনুসারে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশে বিচার পেতে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কেউ পারত পক্ষে আদালতের আশ্রয় নিতে চায় না। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা আমাদের বিচার বিভাগের সীমাবদ্ধতাই সামনে এনেছে। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট দিবসের অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি নিজের আইন পেশার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি করতে না হয়। রাষ্ট্রপতি সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
বিচারকরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন আছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। রায় যথাযথভাবে না হলে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বিচারকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। রায়ের কপি বিষয়ে রাষ্ট্রপতির আহ্বান বাস্তবায়নে বিচার বিভাগকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকারও প্রয়োজন।