রাষ্ট্রের উন্নয়নে নারী-পুরুষ সম-অংশীদার

নাজমুন নাহার জেমি: বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক দিনে হয়নি। বহু দেশের মতো এই দেশের উত্থানের গল্পও অনেক দুঃখের ও সুবিশাল। এই বিশাল গল্পে নারীরা ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। নারীরা এখন আর ঘরে বসে নেই, বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে তারা এখন পুরুষের সম-অংশীদারিত্বের দাবি রাখে। তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে তারা প্রতিনিয়ত দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাচ্ছে।

কোনো জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে আগে সে জাতির নারীকে শিক্ষিত করতে হবে। জাতি গঠনে নারী সমাজের দায়িত্ব পুরুষ সমাজের চেয়ে কম নয়। জাতীয় জীবনে জ্ঞান ও প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি না হলে জাতি অচল হয়ে যায়। নারীরা যেহেতু পুরুষদের মতোই রাষ্ট্রের একটা অংশ, তাই পুরুষদের মতো রাষ্ট্র গঠনে নারীদেরও অংশ নিতে হয়। উন্নত দেশের নারীদের মতো বাংলাদেশের নারীরাও রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধি ও গতিশীলতা এনে দিচ্ছে। বহির্বিশ্বের নারীদের মতো এদেশের নারীদের মধ্যেও নারী জাগরণ শুরু হয়েছে। রাষ্ট্র গঠনে এখন নারীরা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। নারীদের এই সক্রিয়তা ধরে রাখতে হবে। শুধু সংসার ও গৃহকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীকে জাতীয় ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি সর্বস্তরে কর্মময় জীবনের অধিকারী হয়ে দেশের সমৃদ্ধি ও জাতির মঙ্গল ত্বরান্বিত করতে হবে।

রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য নারীর ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন। সন্তান প্রতিপালন ছাড়াও নারীরা আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা, সেবিকা প্রভৃতি নানা পেশায় নিয়োজিত আছে। রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রশাসনিক অধ্যাপক, লেখক, গবেষক প্রভৃতি আরও বহু পরিচয়ে বাংলাদেশের নারীরা আজ সম্মানিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নারী ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছে, ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনে ও রাজনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলনে তারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।

বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় নারীরা অসামান্য অবদান রাখছে। সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার রূপান্তরে নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষুদ্রঋণ ও তৈরি পোশাকশিল্পে নারীদের নিয়োগ এবং এর মাধ্যমে নারীরা তাদের সীমাবদ্ধ গণ্ডি অতিক্রম করে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি পোশাকশিল্প খাত থেকে আসে। মোট গার্মেন্টকর্মীর প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এডিসি) জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এই খাতে নিয়োজিত নারী কর্মীরা মোট কর্মীর ৭০ ভাগ। সরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প, সেবাসহ নানা খাতে কাজ করছে।

গত প্রায় অর্ধশতক ধরে সংগঠিত নারী মুক্তি আন্দোলন বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি, নারীর ক্ষমতায়নে নতুন ধ্যান-ধারণার বিস্তার প্রভৃতি অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের পথ অধিকতর প্রশস্ত হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এদেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাজে ক্রমবর্ধমান অবদান রাখছে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ কিছু নারী উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন। তাদের ক্রমবর্ধমান উদ্যোগ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও অবদান রাখছে। উদ্যোক্তা হিসেবে নারীরা উপার্জনশীল অনানুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় আছেন। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে কাপড় সেলাই, নকশা, বাটিক, বুটিক, নকশিকাঁথা ও খাদ্যসামগ্রী বিক্রি।

সুপ্রাচীনকাল থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নারীই প্রথম কৃষিকাজের সূচনা করে। পুরুষরা যখন শিকারে যেত, তখন নারীরা বাড়ির আশেপাশে ফলের বীজ ছড়িয়ে দিত, চারা লালন করত। কুটিরশিল্পের বিকাশেও নারীর অবদান রয়েছে। ঘরে বসে অবসরে বাঁশ, বেত ইত্যাদি দিয়ে নানা রকম হাতের কাজ তারাই প্রথম শুরু করে। এভাবেই কুটিরশিল্পের সূচনা ও প্রসার ঘটে। পারিবারিক কাজে, সমাজের মঙ্গলে ও দেশের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসস্বীকৃত। অন্যদিকে জানা-অজানা বহু ধরনের নিপীড়নে নারীসমাজ বিপন্ন। বাংলাদেশে নারীর বহু সাফল্যের ইতিহাসের পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে বিপন্ন নারীর আর্তনাদ। সুতরাং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সম-অধিকার এবং তার স্বীকৃতিস্বরূপ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ করতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় নারীর সুযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গৃহীত হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নারীসমাজ আরও ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

শিক্ষার্থী, ইসলামি শিক্ষা বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়