রাষ্ট্রের লক্ষ্য হোক সুষম ও টেকসই সামাজিক উন্নয়ন

মোহাম্মদ আবু নোমান: গরুর খুঁটো উল্গিয়ে রাখলে বা একপাল ভেড়ার রাখাল যদি দায়িত্বহীন হয়, তাহলে ওই গরু পরের জমির ফসল মাড়াই করবে, আর ভেড়ার পালকে হায়েনা চিবিয়ে খাবে এটাই স্বাভাবিক। স্বাধীন বাংলাদেশে যে যেভাবে পারছে ইউদাউট ফেয়ার কোটিপতি হতেই পারে। তবে অন্য দেশেও মিলেওনিয়ার বাড়ে কাজ করে, বিজনেস করে। আর বাংলাদেশে বাড়ে চাঁদাবাজি করে, দুর্নীতি করে, ব্যবসায় সিন্ডিকেট করে, ভেজাল কারবার করে। বিদেশিরা নিজের পরিশ্রমে ধনী হয়, আর বাংলাদেশে শ্রমিক, কর্মচারীদের যথাযথ পারিশ্রমিক না দিয়ে ধনী, শুধু এটুকুই পার্থক্য! আমরা এগিয়ে যাচ্ছি অন্যের বুকে লাথি মেরে, লক্ষ মানুষ পথে বসিয়ে! কোটিপতির ভিড়ে হাজারো পরিবার ‘ফুটাপতি’ তার খবর কে রাখছে? দুর্নীতিবাজ, ভেজাল/সিন্ডিকেট কারবারি, স্বার্থপর, আপন স্বার্থে মগ্ন কোটিপতিতে ভরপুর এদেশ। কোটিপতি বাড়ছে, মানুষের নাকি টাকার অভাব নেই। আবার যখন জাকাত দেয়ার সময় আসবে আমরা কি নিশ্চিত যে, পদদলিত মানুষের লাশ দেখব না? প্রচণ্ড রৌদ্রের মধ্যে টিসিবির গাড়ি আসার আগে শত শত মানুষ একটু কমদামে কেনার জন্য যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বোঝা যায়, দেশের মাথা পিছু আয় কার কত টাকা হয়েছে। এই দৃশ্য উন্নয়নের সঙ্গে যায় না। মানলাম দেশে কোটিপতি বাড়ছেই। কিন্তু তারা কারা?

দেশের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতে গত ৩ মাসে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২৪৫ জন। গত বছরের ডিসেম্বরে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৭ জন। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২ জনে। গত ১৩ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি প্রতি তিন মাস পরপর প্রকাশ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের মার্চে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ জন। এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ৬ হাজার ৫৯৫ জন। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমলেও কোটপতি আমানতকারীদের সংখ্যা বেড়েছে। যাকে আশঙ্কাজনকভাবে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে বললেও আনজাস্টিফিবেল হবে না। সংশ্লিষ্টদের এর বিপরীতে কত লাখ মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নি¤œবিত্তের কাতারে বা নিম্নবিত্ত থেকে বিত্তহীনের কাতারে পৌঁছেছে তা জানলে উন্নয়নের গতিটা বোঝা যেত।

মূলত আমাদের দেশে চলছে, অনিয়ন্ত্রিত ভুঁইফোড় অর্থনীতি। সামষ্টিক সম্পদ না বাড়লেও কোটিপতি বাড়ে, ধনী বাড়ে। এটা একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব! কেননা দেশে ব্যাংকের সোনা হয়ে যায় তামা, টাকা উধাও/ঋণখেলাপি, কয়লা হয়ে যায় ময়লা। রাষ্ট্রের টাকা লুট করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কী? বিশ্বব্যাপী যদি এ পরিসংখ্যান করা হতো, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ অতি ধনী ও দুর্নীতিবাজ কোটিপতি বাড়ার দেশ কোনটি? তাহলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের নাম প্রথম দিকে আসার সম্ভাবনা শতভাগ। আমাদের দেশের নব্য কোটিপতি, ‘আলট্রা ওয়েলদি’ বা অতি ধনী তথা ধনকুব তকমাধারী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সরকারি আমলা-কামলাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব টান দেয়া সম্ভব হলে আনঅ্যাকাউনটেবল অনেক বিষয় বেরিয়ে আসবে।

ইতঃপূর্বে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮-এ বলা হয়েছিল, অতি ধনী বা ধনকুবের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, বিশ্বে ধনকুবের বৃদ্ধির উত্থানে শীর্ষে বাংলাদেশ। যে হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। ওয়েলথ এক্স মার্কিন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি ইনসাইট ভেঞ্চার পার্টনারসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ওয়েলথ এক্সের দাবি, তাদের তথ্যভাণ্ডারে ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ধনকুবেরের তথ্য রয়েছে। ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ থাকলে তাদের আলট্রা ওয়েলদি বা অতি ধনী ও ধনকুবের হিসেবে গণ্য করে সংস্থাটি।

দেশের অর্থনীতিবিদরা দ্রুত কোটিপতি বৃদ্ধি ও দ্রুত অতি ধনী বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে দেশের কতিপয় মানুষের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে, এটা ঠিক। কিন্তু একটা শ্রেণির হাতে বড় অংশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ফলে বৈষম্য অনেক বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। এতে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলছে, দেশ আর গরিব নয়, মানুষের আয় বেড়েছে, বিভিন্ন সূচকে দেশ এগিয়েছে, সব ক্ষেত্রেই আমরা রোল মডেল, আরও কত কী! সত্যি আমরা কতটা এগিয়েছি! বা এগিয়ে থাকলে কারা কীভাবে এগিয়েছে, দেখার কেউ আছে কী?

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে যেমন দেশে কোটিপতির সংখ্যাই বাড়ছে, ঠিক বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে গরিবের সংখ্যাও বাড়ছে। তাহলে কী দাঁড়াল? বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় একশ্রেণির শুধু সম্পদ বাড়বে, আর গরিবরা চিরকাল গরিবই থেকে যাবে? এ খবরে আমরা কি গর্বিত, না কলুষিত হচ্ছি? এটা দেশের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়। এতে গৌরব করার মতো কিছু আছে কী?

সব সরকারের আমলেই কিছু ফন্দিবাজ বিভিন্ন অপকৌশলে ও সরকারি মদদে লাখ লাখ মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন ওরা বিশ্বের ধবকুবের সিরিয়ালে চলে গেছে। শেয়ার বাজার লুট, ব্যাংক লুট, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, যুবক প্রভৃতিতে বিনিয়োগ করে সাধারণ মানুষ হয়ে গেছেন রাস্তার ভিখারি। প্রতিবারই একই বাস্তবতাÑ কিছু লোক শুধু শুধু টাকা পায়, আর কিছু লোক টাকা হারায়! আর সরকারি জমি দখল, রেলওয়ে, বিমান, পরিবহন, গার্মেন্টস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাত দখল করে কোটি টাকার মালিক।

গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে এ যাবৎ আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত বিষয় হচ্ছে দেশের দরিদ্র মানুষের ওপরে চাপিয়ে দেয়া কর। সরকারি ৪৩টি সেবার কোনো একটি নেয়ার প্রয়োজনে ন্যূনতম ২০০০ টাকা কর দিতে হবে। পরবর্তী সময় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, ‘আয়কর হিসেবে দুই হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার।’ আরও আরও গর্বের বিষয় হলো আয়কর অফিসের অনেকেই (সবাই নয়) সীমাহীন ঘুষ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সরকারি সেবার নামে যখন ‘সেবন’ করা হয়, সে গর্বে তো জনগণের গর্ভপাত হওয়ার অবস্থা। এটা কম গর্বের বিষয়? প্রতিদিন বিভিন্নভাবে সরকারি কোষাগারে অর্থ দিয়েও যেন গর্বের সুযোগ হচ্ছে না নাগরিকদের! যারা দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে, তথা বার্ষিক ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে আয় কম, তারা কিন্তু প্রতিটি ওষুধ, পণ্য ক্রয় করতে মূল্য সংযোজন কর দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে কি গর্বিত হওয়া যায় না? মোবাইলে টাকা রিচার্জ করার সঙ্গে সঙ্গে ১৬ পার্সেন্ট ভ্যাট নিয়ে যায়, এতেও কি আমরা গর্বিত হই না?

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এসেছে, সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। যাচ্ছেতাই করে ১০০ জনের অধিকার তছরুফ করে, দু-এক জনের শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার অসম, নিষ্ঠুর, অমানবিক হিংস্র প্রতিযোগিতা চলছে। গরিব আর মধ্যবিত্তরা উপলব্ধি করছেন জীবন কত কষ্টের। শত জনের সুখ কেড়ে নিয়ে দু-চার জন তার সুখ একশ গুন বাড়াতে পারে, কিন্তু তাতে কমে যায় সুখীর সংখ্যা।

যারা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে, তাদের রয়েছে ভবিষ্যতের শঙ্কা, রাজেনৈতিক অস্থিরতা তথা রাজনৈতিক শঙ্কা, দেশের নি¤œ জীবনযাত্রার মানে অনাগ্রহ, আর সবচেয়ে বড় কথা দেশপ্রেমের অভাব। দেশ রসাতলে যায় যাক, সপরিবারে এক সময় বিদেশ পাড়ি দিতে পারলেই হলো। সবকিছু দেখে বলতে হয়, সব সরকারেরই শাসকশ্রেণি এই দেশের কেউ নয়। তারা সেই ইংরেজদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারাও এদেশ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত, আজ এরাও লুটে তাদের দেশেই পাঠাচ্ছে।

বর্তমানে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, নেতা, মন্ত্রী আর তাদের যারা চাটুকর এবং দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কোটিপতি, তাদের আয় সহস্রগুণ বেড়েছে। কোটিপতি বাড়ার এই রোবোটিক হিসাবের নির্মম সত্য হলো, কেউ খেয়ে দেয়ে, উপভোগ করে রেখে যায় তার অদেখা ১৪ পুরুষের জন্য! আর কেউ তার শিশুসন্তানকে খেতে দিতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এটা কি সৎ লোকের আয়; না দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, ঘুষখোর, লুটেরা বা বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের কোটিপতি হওয়া! বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই খবরে সাধারণ মানুষের খুশি হওয়ার কিছু আছে কী?

স্বাধীনতা-পরবর্তী গত পাঁচ দশকে আমার আরও বড় লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম, যদি আমরা দুর্নীতিটা দূর করতে পারতাম! কোটিপতি বাড়ার খবরটি ভালো খবর। সরকারকে আয়ের বৈষম্যের ব্যাপারটিও লক্ষ রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সুষম সামাজিক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একটি সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, এটাই আমাদের কামনা।

সাংবাদিক

abunoman1972@gmail.com