রাষ্ট্র নাগরিকের চরিত্র গঠন করে নাকি নাগরিক রাষ্ট্রের?

মেজবাহ হোসেন   : চারটি উপাদান নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়Ñ সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। এ চারটি উপাদানের মধ্যে জনসমষ্টিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জনগণের জন্যই রাষ্ট্র ভাবনা গড়ে ওঠে। তেমন কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ বা বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে স্বাভাবিকভাবে ভূখণ্ডের তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না, আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই তাদের সরকার নির্বাচন করে। তাই রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, কিন্তু এখানে কে কার চরিত্র গঠনে কতটুকু প্রভাব রাখে সেটিই আজকের আলোচনার বিষয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতে নাগরিকের চরিত্রই রাষ্ট্রের চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে যেমন জনগণের জীবন যাপন, কর্মপদ্ধতি, পেশা-বৃত্তি, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের কারণেই বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক, কৃষি প্রধান (আগে বলা হতো) মুসলিম রাষ্ট্র; ভারত তার সরকারের হাত ধরে একটি হিন্দু রাষ্ট্র থেকে ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সে দেশের জনগণের ব্যাপক চাহিদার কারণে; আর পশ্চিমারা দুনিয়াবি সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার নেশায় নিজেরা সেক্যুলার বা ধর্মহীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রের এই চরিত্র নিরূপণে তাদের ভূখণ্ড, সরকার বা সার্বভৌমত্বের কোনো প্রভাব নেই বরং জনগণই মুখ্য ও একমাত্র ভূমিকা পালন করে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারই সর্বেসর্বা; জনগণ সেখানে কেবলই একটি উপাদান মাত্র (যেমন: চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া)Ñ যেটি আজকের আলোচনার বিষয় নয়।  

রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সরকার ও এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মাধ্যমে আর এই পরিচালন ব্যয়ের সিংহভাগ জোগানো হয় মূলত জনগণের ওপর বিভিন্ন রকম কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ ও আদায় করে। ভ্যাট, ট্যাক্স নির্ধারণের বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে যেমন: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, অতি প্রয়োজনীয় পণ্য, বিলাসবহুল পণ্য, তামাক বা নেশা জাতীয় পণ্য প্রভৃতি। আমাদের এই অঞ্চলে আগে জমিদারি শাসনামলে জমিদারদের যেকোনো প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় খরচ জোগাতে প্রজাদের ওপর ইচ্ছামতো খাজনা বা কর আরোপ ও আদায় করত। কিন্তু বর্তমান সময়ে যেকোনো সভ্য রাষ্ট্র চাইলেই জনগণের ওপর ইচ্ছামতো ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করতে পারে না। রাষ্ট্রের কখনই তার নাগরিকদের সঙ্গে বাণিজ্যিক বা লাভজনক মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়, তাই এই কর আরোপের মাত্রা হতে হয় ন্যূনতম আর সেবা প্রদানের মাত্রা হলো সর্বোচ্চ; এটিই একটি সভ্য রাষ্ট্রের নীতি। সে কারণেই যেকোনো সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের দিকে দেখলে সহজেই বোঝা যায় কেন তার নাগরিকেরা তাদের রাষ্ট্রের প্রতি এত অনুগত, এত শ্রদ্ধাশীল ও এতবেশি দায়বদ্ধ। সেখানে সাধারণ অফিস আদালতগুলোতে নেই ওপেন সিক্রেট রমরমা ঘুষ বাণিজ্য; যেকোনো অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা সদা সোচ্চার। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের দিকে তাকালে খুব সহজেই এটি অনুভব করা যায় যে, একজন ভারতীয়র দেশপ্রেম একজন বাংলাদেশির বা একজন পাকিস্তানির থেকে অনেক বেশি। ভারতের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার ও তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিটি ভারতীয়কে এটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ভারত মাতার স্বার্থকেই সর্বাগ্রে সবার প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এনালাইসিস উইং (র) সার্বক্ষণিকভাবে বিভিন্ন অপকৌশলের মাধ্যমে প্রতিবেশী ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করে ভারতকে সমৃদ্ধ করেই চলছে। সেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু তার ফলে রাষ্ট্রীয় নীতি বা আদর্শের এমন কোনো পরিবর্তন আসে না যা ভারত বা ভারতীয়দের স্বার্থের পরিপন্থি; আর ঠিক এ কারণেই তারা ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি তার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলো যাদের নিজেদেরই বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ সেখান থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্থানে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র-পদে পদে ঘুষ- দুর্নীতি, লুটপাট একরকম রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে; সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাঠামোগতভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও নীতি, আদর্শ ও কার্যকারিতায় সেগুলো প্রায় মুমূর্ষু। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিকে মদদ দেয়া, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে গৃহীত বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বার্থ পরিপন্থি নীতি ও পদক্ষেপের কারণে দেশ দুটির সাধারণ জনগণ গরিব থেকে গরিবতর হয়েছে বিগত দেড় দশকে। পাকিস্তান এখন প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে আর বাংলাদেশের রিজার্ভ (চুরি), মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ, আইএমএফের ঋণ মঞ্জুরি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। বিগত চৌদ্দ বছরে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ৩-৪ গুণ বেশি খরচে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা, কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলা, দেউলিয়া শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেয়া আর অবশেষে আইএমএফের খুব সামান্য ঋণের জন্য মধ্যরাতে সব জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা এবং সর্বশেষ সংসদে দাঁড়িয়ে দরাজ গলায় গ্যাস ও বিদ্যুতের ভর্তুকি আমি কেন দেবÑএ জাতীয় কথা বলা, এসব সামগ্রিক কারণে দেশের সাধারণ জনগণ দেশের মালিকানা ঠিক কতটুকু অনুভব করে যেখানে তাদের মালিকানার সব থেকে ন্যূনতম ক্ষমতা ভোটাধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে। এত গেল সুশাসন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি বা আদর্শের কথা; এবার আসা যাক নাগরিক সুবিধা বা তাদের জীবনমান নিশ্চিতকরণে কোনো রাষ্ট্রের কেমন পদক্ষেপ তার একটি ছোট্ট তুলনামূলক আলোচনায়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনের অন্যতম আশীর্বাদ হচ্ছে গাড়ি, বিশেষত ব্যক্তিগত গাড়ি। মাত্র কিছুকাল আগেও পৃথিবীর অনেক দেশে এই  ব্যক্তিগত গাড়িকে বিলাসী পণ্য হিসেবে দেখা হলেও বর্তমানে অতি বিশ্বায়নের প্রভাবে দ্রুত ও নিরাপদ যাতায়াত বা মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার ও বাজার দুটোই বেড়েছে বহুগুণ, ফলে এই গাড়ি বিষয়টি অনেকটাই নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি উপকরণে পরিণত হয়েছে। নজরকাড়া আউটলুক ও মনভোলানো নিত্য নতুন প্রযুক্তির সংযোজনে এক একটি গাড়ি প্রয়োজনকে পেরিয়ে কিছুটা শখ, শৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রতিটা ছেলের কাছে তো বটেই বরং অনেক মেয়ের কাছেও অধিকার করতে চাওয়া পণ্যের তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছে এ গাড়ি।

যুক্তরাষ্ট্রে একজন গ্র্যাজুয়েট সম্পন্নকারী চাকরিজীবীর বার্ষিক গড়বেতন ৭০,০০০ ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ৭০ লাখ। এ দেশে পৃথিবীর প্রায় সব নামিদামি ও জনপ্রিয় গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত টয়োটা ও হোন্ডা কোম্পানির গাড়িগুলো আমাদের দেশের মতোই এখানেও অনেক জনপ্রিয় এবং এদের একটি ব্র্যান্ড নিউ সেডান কারের দাম গড়ে ২২-২৫ হাজার মার্কিন ডলার, আর একটি এসইউভি মডেলের গাড়ির দাম প্রায় ২৬-২৯ হাজার মার্কিন ডলার। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে একজন ক্রেতাকে গাড়ি কেনার সময় পূর্ণমূল্য নিজেকেই পরিশোধ করতে হয় না, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নামমাত্র সুদে ও সহজ শর্তে কার লোন দিয়ে থাকে যেটাকে এখানে ফাইন্যান্সিং বলা হয়। তাহলে হিসেব দাঁড়াল যে একজন আমেরিকান বছরে ৭০ লাখ টাকা আয় করেন এবং ২৫ লাখ টাকাতে একটি বিশ্বমানের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির গর্বিত মালিক হতে পারেন। ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ির প্রচলন কম, তাদের জন্য আছে মেট্রোরেল ও মাসট্রানজিটের মতো গণ পরিবহণ এবং পৃথক বাইসাইকেল লেন। এগুলোর সেবার মানের কারণে সেখানকার মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির প্রতি তেমন আগ্রহী নয়। এবার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দিকে লক্ষ্য করি। তাদের জাতীয় পে স্কেলের ১৮টি ধাপের মধ্যে সর্বনি¤œ ধাপের মূল বেতন ১৮,০০০ রুপি আর সর্বোচ্চ ধাপে ২,৫০,০০০ রুপি। ভারতে টয়োটা, হোন্ডা ও হুন্দাইয়ের পাশাপাশি টাটা, মারুতি ও মাহিন্দ্রার মতো লোকাল ব্র্যান্ডগুলো ও গাড়ি উৎপাদন করে। ভারতে ৫.৫-৭ লাখ রুপিতে ১১০০-১২০০ সিসির হ্যাচব্যাক, ৮-১২ লাখ রুপিতে সেডান কার ও ১৫-২০ লাখ রুপিতে এসইউভি গাড়ি কিনতে পাওয়া যায়। (বাকি অংশ আগামীকাল]

শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ

হাবিপ্রবি (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত)

সবুনধযযড়ংংধরহ১৫Ñমসধরষ.পড়স