মো. নিজাম উদ্দিন: স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল ১৯৬১ সালে। তখন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মাতীরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের প্রায় এক হাজার মিটার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইসঙ্গে প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় ২৬০ একর জমি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে সে স্বপ্ন থামে অঙ্কুরেই। ১৯৬৪ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে যন্ত্রপাতি জাহাজে আসছিল, সে জাহাজ নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচিতে ভেড়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জামবাহী সে জাহাজ। আর সেসব সরঞ্জামে রূপপুরের পরিবর্তে করাচিতে গড়ে তোলা হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এরপর অর্ধ শতাব্দী ধরে প্রকল্পটি নিয়ে আটটি দেশের সঙ্গে আলোচনা হয়। তবে এগুলোর কোনোটিই চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি। ১৯৬৩ সালের কথাই ধরুন। তখন ৭০ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬৪ সালে কানাডা সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। পরে তা থেমে যায়। ১৯৬৬ সালে আবারও আলোচনা শুরু হয়। সেবার কানাডা ছাড়াও সুইডেন ও নরওয়ের সঙ্গে ১৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনা হয়। অতীতের মতো সে দফার উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপরও বিভিন্ন সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে কোনোটিই কার্যকর হয়নি। এবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরের মধ্য দিয়ে সে উদ্যোগের যাত্রা শুরু। ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি রোসাটম ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক এবং একই বছরের ২১ মে দুদেশের মধ্যে রূপরেখা চুক্তি সই হয়।
২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সময়ের বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রায়োগিক পরিকল্পনা সম্পর্কিত চুক্তি হয়। একই বছরের ১ আগস্ট মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করে। সেই একই বছরের ৩১ অক্টোবর নিরাপত্তা ও আইনি রূপরেখা উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন হয়। এরপর ২ নভেম্বর ঢাকায় চুক্তি হয়। প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের কিছুদিন আগে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল অর্থায়ন বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করে।
এর ফলে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর পাবনার রূপপুরে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল সাত বছর ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে ও দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
যদিও প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আর কতটুকুই বা নিরাপদ? জাপানের ফুকুশিমা আর চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে এ প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। সাধারণ নাগরিকের ভয় পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে। বাংলাদেশের সর্বোত্তম নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই রাশিয়া তাদের সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি ভিভিইআর ১২০০ (ঠঠঊজ ১২০০) মডেলটি আমাদের দিচ্ছে। বিশ্বের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো মাথায় রেখেই রাশিয়া তার সর্বশেষ মডেলের আধুনিকায়ন করে। আর তাই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। রাশিয়ার অভ্যন্তরেই নবোভরনেজ ও লেনিনগ্রাদে ভিভিইআর ১২০০ (ঠঠঊজ ১২০০) মডেলটি চালু করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশটির জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ভবিষ্যতে তুরস্ক ও ফিনল্যান্ডসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশে এটি ব্যবহার করা হবে। বরং আমাদের জন্য খুশির খবর, আমরা রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তিটি গ্রহণ করছি।
বাংলাদেশের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিদ্যুতের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প নেই। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে নতুন পথের সন্ধানে যেতেই হবে আমাদের। আর এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো বিকল্প নেই। এশিয়ার বেশির ভাগ জনবহুল দেশ যেমন চীন, ভারত, কোরিয়াসহ আরও অনেক দেশ এর প্রয়োজনীয়তা আগেই টের পেয়েছে এবং পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে ও করছে। আমরাও আর পিছিয়ে নেই। বিদ্যুৎ একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক খুব ওতপ্রোত হলেও জনসংখ্যার মাত্র ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎসেবা পান। তবে তা নিরবচ্ছিন্ন নয়। গ্রামাঞ্চলে এর অবস্থা আরও প্রকট। এ অসহনীয় পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা হলে যে কোনো নাগরিকেরই খুশি হওয়ার কথা।
নিরাপত্তার সব দিক খুঁটিয়ে দেখেই আমরা মডেলটি নিচ্ছি। ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ধারণ ক্ষমতা রয়েছে সর্বশেষ আধুনিক এ মডেলটির। আর পাবনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলো ৭.৮ রিখটার স্কেল, যার কেন্দ্রস্থল ছিল নেপালে। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ইতিহাসে এই মাত্রার ভূমিকম্প বিরল। আর রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটম থেকে এও বলা হয়েছে, এ মডেলটি যে কোনো ধরনের বিমান হামলা থেকেও রক্ষা পেতে সক্ষম। বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তার সিংহভাগ উৎপাদন করে আরেভা ফ্রান্স। এরপরই আছে রাশিয়ার রোসাটম। জনবহুল দেশের কথা মাথায় রেখেই সম্পূর্ণ নিরাপত্তা সংবলিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হবে বাংলাদেশে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অনেকের ধারণা এসব বর্জ্য বাংলাদেশের কোনো এক অংশে মাটিতে পুঁতে ফেলা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এ কাজ করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাংলাদেশের জন্য কঠিন এ কাজটির দায়িত্ব নিয়েছে রাশিয়া। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবঋত ইউরেনিয়ামের বর্জ্য রাশিয়া তাদের নিজেদের তদারকিতে রাশিয়ায় ফেরত নিয়ে যাবে। আর নিরাপদ ও নির্ভরশীলতার ব্যাপারে রাশিয়ার বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক মান নির্ণয়কারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (ওঅঊঅ) মান অনুযায়ীই তৈরি করা হয়েছে। তাই আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। রাশিয়াকে উন্নত পরমাণু শক্তির পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে ও দেশটি উন্নত এ প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করছে।
তবু একটি প্রশ্ন থেকে যায়, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের এত বড় প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে? কীভাবে করবে? রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছর রাশিয়ায় বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে কয়েকটি দল নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে রাশিয়ায় আসছে। আরও দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য বাংলাদেশ থেকে বাছাই করে তিন বছর মেয়াদি মাস্টার্স প্রোগ্রাম এবং পাঁচ বছর মেয়াদি স্পেশালিস্ট প্রোগ্রামে রাশিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পড়াশোনা শেষ করে দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তারা অর্জিত জ্ঞান ও মেধা কাজে লাগাবেন। তারা মুখিয়ে আছেন দেশের ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিজেদের সবটুকু দিয়ে কাজ করার জন্য। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পরে কয়েক বছর প্রকল্পটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাশিয়া সাহায্য সহযোগিতা করবে। কিন্তু সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাই দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করবে অগ্রযাত্রার নতুন এক মাইলফলক। বিশ্বায়নের এ যুগে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদিত দেশগুলোর মধ্যে। তারুণ্যে ভরপুর ভবিষ্যতের পরমাণু প্রকৌশলীরা অপেক্ষায় আছেন নতুন বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে।
শিক্ষার্থী
ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনিভার্সিটি মস্কো, রাশিয়া