ইসমাইল আলী: রেলের উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন হয় সাত বছর আগে। এ সময়ে রেলওয়ের জন্য প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। সে তুলনায় রেলের দৃশ্যমান উন্নয়ন খুবই কম। এমনকি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইঞ্জিন-কোচও যুক্ত হয়নি রেলের বহরে। এতে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) পেরিয়ে গেছে অধিকাংশ ইঞ্জিন-কোচের (রোলিং স্টক)। এগুলোর বড় একটি অংশ অচল পড়ে আছে।
রেলওয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে রেওলয়ের প্রায় ২০ শতাংশ ইঞ্জিন-কোচ অচল পড়ে আছে। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ ইঞ্জিন ও ১৯ শতাংশ কোচ অচল। এছাড়া বর্তমানে রেলের ইঞ্জিন ও কোচের বড় অংশের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। এছাড়া ৪৫ শতাংশ পণ্য ও তেলবাহী ওয়াগনের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। এর বাইরে রিলিফ ট্রেনের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে ৭১ শতাংশের।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে রেলওয়ের বহরে ইঞ্জিন রয়েছে ২৭০টি। এর মধ্যে মিটারগেজ ইঞ্জিন রয়েছে ১৭৮টি ও ব্রডগেজ ৯২টি। এগুলোর মধ্যে অচল পড়ে আছে যথাক্রমে ৫৩টি ও ১০টি। অর্থাৎ বর্তমানে রেলের ৬৩টি বা ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ইঞ্জিন অচল। তবে বর্তমানে রেলের ১৮২টি ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে, যা মোট ইঞ্জিনের ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।
ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ২০ বছর। এ ধরনের ইঞ্জিন রয়েছে ৮৮টি। এর মধ্যে ৪৯টি মিটারগেজ ও ৩৯টি ব্রডগেজ। বাকিগুলোর মধ্যে ৩৭টির আয়ুষ্কাল ২১-৩০ বছরের মধ্যে। ৩১-৪০ বছরের মধ্যে রয়েছে আরও ৬০টি আর ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে রয়েছে ৮৫টি ইঞ্জিন। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিন ব্যবহার করায় নিয়মিতই সেগুলো বিকল হচ্ছে যাত্রাপথে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পাঁচ বছরে ২০টি মিটারগেজ ও ২৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনা হয়। তবে নানা জটিলতায় গত পাঁচ বছরে নতুন ইঞ্জিন কেনা সম্ভব হয়নি। যদিও সম্প্রতি ৮০টি মিটারগেজ ও ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনার জন্য চুক্তি হয়েছে। এছাড়া আরও ৩০টি ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া চলছে। তিন বছরের মধ্যে এগুলো রেলের বহরে যুক্ত হবে। তখন রেলওয়ের ইঞ্জিনের চিত্র বদলে যাবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রেলওয়ের বহরে যাত্রীবাহী কোচ রয়েছে এক হাজার ৫৭৮টির। এর মধ্যে মিটারগেজ কোচ রয়েছে এক হাজার ১৫০টি ও ব্রডগেজ ৪২৮টি। এসব কোচের মধ্যে ২২৮টি মিটারগেজ ও ৭৫টি ব্রডগেজ কোচ অচল। অর্থাৎ ৩০৩টি অচল পড়ে আছে, যা মোট কোচের ১৯ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে রেলের মেয়াদোত্তীর্ণ কোচের সংখ্যা ৬৮৬টি, যা মোট কোচের ৪৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
সাধারণত কোচের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ৩৫ বছর। এ মেয়াদের মধ্যে রয়েছে ৮৯২টি কোচ। এসব কোচের মধ্যে ৬২৬টি মিটারগেজ ও ২৬৬টি ব্রডগেজ কোচের আয়ুষ্কাল। আর মেয়াদোত্তীর্ণ মিটারগেজ কোচ রয়েছে ৫২৪ ও ব্রডগেজ ১৬২টি। নিয়মিত মেরামতের অভাবে এগুলোর বড় অংশ প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকারের প্রথম পাঁচ বছর কয়েক দফা চেষ্টা করেও কোচ কেনার উদ্যোগ ব্যর্থ হয় রেলওয়ের। তবে ২০১৬ সালে ভারত থেকে ১২০টি ব্রডগেজ এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ১০০ মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা হয়। ইন্দোনেশিয়া থেকে আরও ২০০ মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা হয়েছে, যেগুলো রেলের বহরে যুক্ত হতে শুরু করেছে। এর বাইরে চীন থেকে ৩০০ ও কোরিয়া থেকে ২০০ কোচ কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো যুক্ত হলে কোচ সংকটের চিত্রও বদলে যাবে।
সূত্রমতে, ইঞ্জিন-কোচের বাইরে রেলওয়ের পণ্য ও তেলবাহী ওয়াগন রয়েছে আট হাজার ৬৮০টি। এর মধ্যে ছয় হাজার ৮৫০টি মিটারগেজ ও এক হাজার ৮৩০টি ব্রডগেজ ওয়াগন রয়েছে। এসব ওয়াগনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ৪৫ বছর। এ আয়ুষ্কালের মধ্যে রয়েছে চার হাজার ৭৪১টি ওয়াগনের। অর্থাৎ তিন হাজার ৯৩৯টি বা ৪৫ শতাংশ ওয়াগনের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে তিন হাজার ২৯৯টি মিটারগেজ ও ৬৪০টি ব্রডগেজ ওয়াগন রয়েছে।
যদিও বর্তমান সরকারের আমলে তেলবাহী ২৪৬টি ও পণ্যবাহী ২২০টি ওয়াগন কেনা হয়। তবে পুরোনো ওয়াগনে মাঝে মধ্যেই বিকল হয়ে পড়ে পণ্যবাহী ট্রেন। এছাড়া প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে তেলবাহী ওয়াগনও।
এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেন উদ্ধারে ক্রেন রয়েছে ১৪টি। এগুলোর ৯টি মিটারগেজ ও পাঁচটি ব্রডগেজ। এর মধ্যে ১০টির আয়ুষ্কাল (২০ বছর) পেরিয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের সময় কেনা একটি ক্রেন ঠিকমতো কাজ করলেও বাকিগুলো দিয়ে উদ্ধারকাজ অনেক সময় বিঘিœত হয়।
উল্লেখ্য, রেলওয়ে খাতের উন্নয়নে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ছয় হাজার ৮০ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চার হাজার ২২০ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিন হাজার ৪৩২ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিন হাজার ৫৩৪ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দুই হাজার ৮৭৪ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে এক হাজার ৯০৯ কোটি ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ৮৭৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ২২ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছর এ খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
