নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনার পর থেকে ঢাকার রেস্তোরাঁগুলোর অভ্যন্তরে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানির মদদে গড়ে উঠছে ধূমপানের স্থান। যার মূল উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা এবং সিগারেটকে মানুষের কাছে সহজলভ্য করা। সিগারেট কোম্পানিগুলো টাকা দিয়ে এসব ধূমপানের স্থান করে দেয়। আর মালিকরা টাকার লোভে সেই সুবিধা করে দিচ্ছে। ফলে ধূমপায়ীদের পাশাপাশি অধূমপায়ীরাও এই স্মোকিং জোন থেকে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। একইসঙ্গে রেস্টুরেন্টে এ ধরনের স্মোকিং জোন শুধু পরোক্ষ ধূমপানেরই কারণ নয় বরং এর ফলে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক অগ্নি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় সিগারেটের ফেলে দেয়া অংশ থেকে।
রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গতকাল ‘রেস্টুরেন্টে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান: জনস্বাস্থ্য হুমকিতে’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। এইড ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি), ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্টিভিটিস অব সোসাইটি (ডাস্), গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস), জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতি (নাটাব), ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) সমন্বিতভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, অনেক এসি রুমের ভেতরে আছে ধূমপানের কক্ষ। রেস্টুরেন্টে এসব ধূমপানের স্থান যেন মরণফাঁদ। যে কোনো সময় প্রাণ যেতে পারে শত মানুষের। রেস্টুরেন্টে মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ও বিনোদনের জন্য যায়, সেখানে ভালো ওয়াশরুম, ছোট লাইব্রেরি, বাচ্চাদের খেলার স্থান, ব্রেস্টফিডিং কর্নারের মতো মানসিক ও স্বাস্থ্যসম্মতবিষয়ক রাখা জরুরি। অথচ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে সিগারেট কোম্পানির মদদে গড়ে তুলছে ধূমপানে কক্ষ। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে জননিরাপত্তা।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী। বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি ও ক্যান্সার বিশেষ ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের পরিচালক ইকবাল মাসুদ, প্রত্যাশা মাদকবিরোধী সংগঠনের সভাপতি ও বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমেদ, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী, গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির পরিচালক একেএম মাকসুদ ও ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের কারিগরি পরামর্শক ফাহিমুল হক। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন টিসিআরসির প্রকল্প পরিচালক মো. বজলুর রহমান এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা। এছাড়া অনুষ্ঠানে ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কারিগরি উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলমসহ তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত দেন।
প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ঢাকায় ৪০ দশমিক সাত শতাংশ রেস্টুরেন্টে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রয়েছে। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ রেস্টুরেন্টে সিগারেট বিক্রি হয়। অথচ এগুলো এক সময় কোথাও ছিল না। প্রতিনিয়ত তামাক কোম্পানির সহায়তায় এসব স্থান গড়ে তোলা হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব রেস্টুরেন্টের মধ্যে সাড়ে ২৩ শতাংশ রেস্টুরেন্টে বাচ্চাদের খেলার স্থান এবং মাত্র চার দশমিক ৯ শতাংশ রেস্টুরেন্টে ব্রেস্টফিডিং কর্নার রয়েছে। ফলে তারাও মারাত্মকভাবে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছে।
গবেষণার ফলাফলে আরও বলা হয়েছে, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থানে ব্যবহারকারীদের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ ব্যবহারকারী পাওয়া গেছে। ফলে রেস্টুরেন্টে ধূমপানের স্থান তরুণদের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ তাদের সুরক্ষায় সাড়ে ৪৫ শতাংশ রেস্টুরেন্টে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। এ গবেষণার জন্য মোট ৮১টি রেস্টুরেন্ট নির্বাচন করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩৩টি রেস্টুরেন্টে ধূমপানের স্থান রয়েছে।
বক্তারা বলেন, ইলেকট্রিক শর্ট-সার্কিটের পর সিগারেট বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় প্রধান কারণ। ২০২৩ সালে দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে ৪ হাজার ৯০৬টি সিগারেটের কারণে হয়েছে। এটি মোট অগ্নিকাণ্ডের ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অব্যাহতভাবে সিগারেটের ফেলে দেয়া টুকরো থেকে অগ্নিকাণ্ডের অনুপাত ও সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। আর এ অবস্থায় কিছু রেস্টুরেন্ট মালিক রেস্টুরেন্টগুলোকে সিগারেটের অগ্নিকাণ্ডে ঝুঁকির ডিপো বানাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে যেহেতু রান্না করা হয়, তাই সেখানে একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার থাকে। এছাড়া অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট এসিযুক্ত। এমন স্থানে ধূমপানের জলন্ত সিগারেটের টুকরো নিমিষেই পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ করে তুলতে পারে তার প্রমাণ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড থেকেই পাওয়া যায়।
গবেষণার সুপারিশে বলা হয়, রেস্টুরেন্ট থেকে জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ধূমপানের জন্য নির্ধারিত সব স্থান তুলে দিতে হবে, রেস্টুরেন্টে জনস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, স্মোকিং জোনের পরিবর্তে ভালো ওয়াশরুম, ছোট লাইব্রেরি, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, ব্রেস্টফিডিং কর্নার গড়ে তুলতে আইনি বাধ্যবাধকতায় রাখতে এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপানের স্থান না রাখার বিধান স্থানীয় সরকার আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনসহ বিভিন্ন আইনে যুক্ত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন চিকিৎসক, তামাক নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, উন্নয়নকর্মী ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।